পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৬
চোখের বালি

হাতে ত্যাগ করিতে পারে না তাহা আজ বিহারীকে দেখিয়া বুঝিতে পাঝিল।

 ব্যর্থরোষে তীব্র বিদ্রুপের স্বরে মহেন্দ্র বিনোদিনীকে কহিল, “এখন তবে বঙ্গভূমিতে মহেন্দ্রের প্রস্থান, বিহারীর প্রবেশ। দৃশ্যটি সুন্দর― হাততালি দিতে ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু আশা করি, এই শেষ অঙ্ক, ইহার পরে আর-কিছুই ভালো লাগিবে না।”

 বিনোদিনীর মুখ রক্তিম হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের আশ্রয় লইতে যখন তাহাকে বাধ্য হইতে হইয়াছে, তখন এ অপমানের উত্তর তাহার আর কিছুই নাই―ব্যাকুল বৃষ্টিতে সে কেবল একবার বিহারীর মুখের দিকে চাহিল।

 বিহারী খাট হইতে উঠিল; অগ্রসর হইয়া কহিল, “মহেন্দ্র, তুমি বিনোদিনীকে কাপুরুষের মতো অপমান করিয়ো না― তোমার ভদ্রতা যদি তোমাকে নিষেধ না করে, তোমাকে নিষেধ করিবার অধিকার আমার আছে।”

 মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ইহারই মধ্যে অধিকার সাব্যস্ত হইয়া গেছে? আজ তোমার নূতন নামকরণ করা যাক― বিনোদবিহারী।”

 বিহারী অপমানের মাত্রা চড়িতে দেখিয়া মহেন্দ্রের হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল, “মহেন্দ্র, বিনোদিনীকে আমি বিবাহ করিব, তোমাকে জানাইলাম; অতএব এখন হইতে সংযতভাবে কথা কও।”

 শুনিয়া মহেন্দ্র বিস্ময়ে নিস্তব্ধ হইয়া গেল, এবং বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল— বুকের মধ্যে তাহার সমস্ত রক্ত তোলপাড় করিতে লাগিল।

 বিহারী কহিল, “তোমাকে আর-একটি খবর দিবার আছে― তোমার মা মৃত্যুশয্যায় শয়ান, তাঁহার বাঁচিবার কোনো আশা নাই। আমি আজ রাত্রের গাড়িতেই যাইব― বিনোদিনীও আমার সঙ্গে ফিরিবে।”

 বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল; কহিল, “পিসিমার অসুখ?”

 বিহারী কহিল, “সারিবার অসুখ নহে। কখন কী হয় বলা যায় না।”

 মহেন্দ্র তখন আর-কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

 বিনোদিনী তখন বিহারীকে বলিল, “যে কথা তুমি বলিলে তাহা তোমার মুখ দিয়া কেমন করিয়া বাহির হইল। এ কি ঠাট্টা।”

 বিহারী কহিল, “না, আমি সত্যই বলিয়াছি, তোমাকে আমি বিবাহ করিব।”

 বিনোদিনী। এই পাপিষ্ঠাকে উদ্ধার করিবার জন্য?

 বিহারী। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলিয়া, শ্রদ্ধা করি বলিয়া।

 বিনোদিনী। এই আমার শেষ পুরস্কার হইয়াছে। এই যেটুকু স্বীকার করিলে,