পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩৬
চোখের বালি

জোড় লাগিয়া আবার ঠিক তেমনি হইয়াছে— ভাঙনের দাগটুকুও মিলাইয়া গেছে। মহেন্দ্র কি আর-কেহ তোর মুখ দেখিয়া নিজেকে অপরাধী বলিয়া মনে করিবে না। চুনি, ইহা আমার অনুরোধ বা উপদেশ নহে, ইহা তোর মাসিমার আদেশ। আমি যখন কাশী চলিয়া যাইব, আমার এই কথাটি একদিনের জন্যও ভুলিস নে।”

 আশা চায়ের পেয়ালা প্রভৃতি লইয়া বিনোদিনীর কাছে উপস্থিত হইল, কহিল, “জল কি গরম হইয়াছে? আমি চায়ের দুধ আনিয়াছি।”

 বনোদিনী আশ্চর্য হইয়া আশার মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “বিহারীঠাকুরপো বারান্দায় বসিয়া আছেন, চা তুমি তাহার কাছে পাঠাইয়া দাও, আমি ততক্ষণ পিসিমার জন্য মুখ ধুইবার বন্দোবস্ত করিয়া রাখি। তিনি বোধ হয় এখনই উঠিকেন।”

 বিনোদিনী চা লইয়া বিহারীর কাছে গেল না।— বিহারী ভালোবাসা স্বীকার করিয়া তাহাকে যে অধিকার দিয়াছে, সেই অধিকার স্বেচ্ছামতে খাটাইতে তাহার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। অধিকার লাভের যে মর্যাদা আছে সেই মর্যাদা রক্ষা করিতে হইলে অধিকার প্রয়োগকে সংযত করিতে হয়। যতটা পাওয়া যায় ততটা লইয়া টানাটানি করা কাঙালকেই শোভা পায়— ভোগকে খর্ব করিলেই সম্পদের যথার্থ গৌরব। এখন বিহারী তাহাকে নিজে না ডাকিলে, কোনো-একটা উপলক্ষ করিয়া বিনোদিনী তাহার কাছে আর যাইতে পারে না।

 বলিতে-বলিতেই মহেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। আশার বুকের ভিতরটা যদিও ধড়াস করিয়া উঠিল, তবু সে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া স্বাভাবিক স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “তুমি এত ভোরে উঠিলে যে? পাছে আলো লাগিয়া তোমার ঘুম ভাঙে, তাই আমি জানলা-দরজা সব বন্ধ করিয়া আসিয়াছি।”

 বিনোদিনীর সম্মুখেই আশাকে এইরূপ সহজভাবে কথা কহিতে শুনিয়া মহেন্দ্রের বুকের একটা পাথর যেন নামিয়া গেল। সে আনন্দিতচিত্তে কহিল, “মা কেমন আছেন তাই দেখিতে আসিয়াছি— মা কি এখনো ঘুমাইতেছেন।”

 আশা কহিল, “হাঁ, তিনি ঘুমাইতেছেন, এখন তুমি যাইয়ো না। বিহারীঠাকুরপো বলিয়াছেন, তিনি আজ অনেকটা ভালো আছেন। অনেক দিন পরে কাল তিনি সমস্ত রাত ভালো করিয়া ঘুমাইয়াছেন।”

 মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকীমা কোথায়।”

 আশা তাঁহার ঘর দেখাইয়া দিল।