পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৮
চোখের বালি

 মহেন্দ্র কহিল, “বিলক্ষণ! আমরা তো তার জন্যই অপেক্ষা করিয়া আছি।”

 বিহারী কহিল, “সেই কথাটি তাঁহাকে জানাইয়া পত্র লিখিতে তোমার অল্পই সময় লাগিবে, কিন্তু তাঁহার সুখের সীমা থাকিবে না। বোঠান, মহিনদাকে সেই দু-মিনিট ছুটি দিতে হইবে, তোমার কাছে আমার এই আবেদন!”

 আশা রাগিয়া চলিয়া গেল— তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “কী শুভক্ষণেই যে তোমাদের দেখা হইয়াছিল। কিছুতেই সন্ধি হইল না— কেবলই ঠুকঠাক চলিতেছে।”

 বিহারী কহিল, “তোমাকে তোমার মা তো নষ্ট করিয়াছেন, আবার স্ত্রীও নষ্ট করিতে বসিয়াছে। সেইটে দেখিতে পারি না বলিয়াই সময় পাইলে দুই-এক কথা বলি।”

 মহেন্দ্র। তাহাতে ফল কী হয়।

 বিহারী। ফল তোমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই হয় না, আমার সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ হয়।


১০

বিহারী নিজে বসিয়া মহেন্দ্রকে দিয়া চিঠি লিখাইয়া লইল এবং সে চিঠি লইয়া পরদিনই রাজলক্ষ্মীকে আনিতে গেল। রাজলক্ষ্মী বুঝিলেন, এ চিঠি বিহারীই লিখাইয়াছে— কিন্তু তবু আর থাকিতে পারিলেন না। সঙ্গে বিনোদিনী আসিল।

 গৃহিণী ফিরিয়া আসিয়া গৃহের যেরূপ দুরবস্থা দেখিলেন—সমস্ত অমার্জিত, মলিন, বিপর্যস্ত— তাহাতে বধূর প্রতি তাঁহার মন আরো যেন বক্র হইয়া উঠিল।

 কিন্তু বধুর এ কী পরিবর্তন। সে যে ছায়ার মতো তাঁহার অনুসরণ করে। আদেশ না পাইলেও তাঁহার কর্মে সহায়তা করিতে অগ্রসর হয়। তিনি শশব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠেন, “রাখো রাখো, ও তুমি নষ্ট করিয়া ফেলিবে। জান না যে কাজ সে কাজে কেন হাত দেওয়া।”

 রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, অন্নপূর্ণা চলিয়া যাওয়াতেই বধূর এত উন্নতি হইয়াছে। কিন্তু তিনি ভাবিলেন, ‘মহেন্দ্র মনে করিবে, খুড়ি যখন ছিল তখন বধূকে লইয়া আমি বেশ নিষ্কণ্টকে সুখে ছিলাম——আর মা আসিতেই আমার বিরহদুঃখ আরম্ভ হইল। ইহাতে অন্নপূর্ণা যে তাহার হিতৈষী এবং মা যে তাহার সুখের অন্তরায়, ইহাই প্রমাণ হইবে। কাজ কী।’

 আজকাল দিনের বেলা মহেন্দ্র ডাকিয়া পাঠাইলে, বধু যাইতে ইতস্তত করিত—