পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬
চোখের বালি

সময় কই! পড়িবার সময় ডাক্তারি বই পড়িব, অবকাশের সময় তুমি আছ, ইহার মধ্যে সখীকে কোথায় আনিবে।”

 আশা কহিল, “আচ্ছা, তোমার ডাক্তারিতে ভাগ বসাইব না, আমারই অংশ আমি বালিকে দিব!”

 মহেন্দ্র কহিল, “তুমি তো দিবে, আমি দিতে দিব কেন।”

 আশা যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে, মহেন্দ্র বলে, ইহাতে তাহার স্বামীর প্রতি প্রেমের খর্বতা প্রতিপন্ন হয়। মহেন্দ্র অহংকার করিয়া বলিত, ‘আমার মতো অনন্যনিষ্ঠ প্রেম তোমার নহে।’ আশা তাহা কিছুতেই মানিত না— ইহা লইয়া ঝগড়া করিত, কাঁদিত, কিন্তু তর্কে জিতিতে পারিত না।

 মহেন্দ্র তাহাদের দুজনের মাঝখানে বিনোদিনীকে সুচ্যগ্র স্থান ছাড়িয়া দিতে চায় না, ইহাই তাহার গর্বের বিষয় হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের এই গর্ব আশার সহ্য হইত না, কিন্তু আজ সে পরাভব স্বীকার করিয়া কহিল, “আচ্ছা বেশ, আমার খাতিরেই তুমি আমার বালির সঙ্গে আলাপ করো।”

 আশার নিকট মহেন্দ্র নিজের ভালোবাসার দৃঢ়তা ও শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করিয়া অবশেষে বিনোদিনীর সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য অনুগ্রহপূর্বক রাজী হইল। বলিয়া রাখিল, “কিন্তু তাই বলিয়া যখন-তখন উৎপাত করিলে বাঁচিব না।”

 পরদিন প্রত্যুষে বিনোদিনীকে আশা তাহার বিছানায় গিয়া জড়াইয়া ধরিল। বিনোদিনী কহিল, “এ কী আশ্চর্য। চকোরী যে আজ চাঁদকে ছাড়িয়া মেঘের দরবারে!”

 আশা কহিল, “তোমাদের ও-সব কবিতার কথা আমার আসে না ভাই, কেন বেনা-বনে মুক্ত ছড়ানো; যে তোমার কথার জবাব দিতে পারিবে, একবার তাহার কাছে কথা শোনাও'সে।”

 বিনোদিনী কহিল, “সে রসিক লোকটি কে।”

 আশা কহিল, “তোমার দেবর, আমার স্বামী। না ভাই, ঠাট্টা নয়— তিনি তোমার সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছেন।”

 বিনোদিনী মনে মনে কহিল, ‘স্ত্রীর হুকুমে আমার প্রতি তলব পড়িয়াছে, আমি অমনি ছুটিয়া যাইব, আমাকে তেমন পাও নাই।’

 বিনোদিনী কোনোমতেই রাজী হইল না। আশা তখন স্বামীর কাছে বড়ে অপ্রতিভ হইল।

 মহেন্দ্র মনে মনে বড়ো রাগ করিল। তাহার কাছে বাহির হইতে আপত্তি!