পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৫১

 আশাকে আবার একটা কৌশল করিতে হইল এবং সে কৌশল গোড়া হইতেই বিনোদিনীর অগোচর রহিল না।

 মতলব এই হইল, মধ্যাহ্নে আশা তাহাকে নিজের শোবার ঘরে আনিয়া কোনোমতে ঘুম পাড়াইবে এবং মহেন্দ্র সেই অবস্থায় ছবি তুলিয়া অবাধ্য সখীকে উপযুক্তরূপ জব্দ করিবে।

 আশ্চর্য এই, বিনোদিনী কোনোদিন দিনের বেলায় ঘুমায় না। কিন্তু আশার ঘরে আসিয়া সেদিন তাহার চোখ ঢুলিয়া পড়িল। গায়ে একখানি লাল শাল দিয়া, খোলা জানালার দিকে মুখ করিয়া, হাতে মাথা রাখিয়া, এমনি সুন্দর ভঙ্গিতে ঘুমাইয়া পড়িল যে মহেন্দ্র কহিল, “ঠিক মনে হইতেছে, যেন ছবি লইবার জন্য ইচ্ছা করিয়াই প্রস্তুত হইয়াছে।”

 মহেন্দ্র পা টিপিয়া টিপিয়া ক্যামেরা আনিল। কোন্ দিক হইতে ছবি লইলে ভালো হইবে, তাহা স্থির করিবার জন্য বিনোদিনীকে অনেকক্ষণ ধরিয়া নানা দিক হইতে বেশ করিয়া দেখিয়া লইতে হইল। এমন-কি, আর্টের খাতিরে অতি সন্তর্পণে শিয়রের কাছে তাহার খোলা চুল এক জায়গায় একটু সরাইয়া দিতে হইল; পছন্দ না হওয়ায় পুনরায় তাহা সংশোধন করিয়া লইতে হইল। আশাকে কানে কানে কহিল, “পায়ের কাছে শালটা একটুখানি বাঁ-দিকে সরাইয়া দাও।”

 অপটু আশা কানে কানে কহিল, “আমি ঠিক পারিব না, ঘুম ভাঙাইয়া দিব। তুমি সরাইয়া দাও।”

 মহেন্দ্র সরাইয়া দিল।

 অবশেষে যেই ছবি লইবার জন্য ক্যামেরার মধ্যে কাচ পুরিয়া দিল, অমনি যেন কিসের শব্দে বিনোদিনী নড়িয়া, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া, ধড়্ফড়্ করিয়া উঠিয়া বসিল। আশা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। বিনোদিনী বড়োই রাগ করিল; তাহার জ্যোতির্ময় চক্ষু-দুইটি হইতে মহেন্দ্রের প্রতি অগ্নিবাণ বর্ষণ করিয়া কহিল, “ভারি অন্যায়!”

 মহেন্দ্র কহিল, “অন্যায়, তাহার আর সন্দেহ নাই। কিন্তু চুরিও করিলাম, অথচ চোরাই মাল ঘরে আসিল না, ইহাতে যে আমার ইহকাল পরকাল দুই গেল। অন্যায়টাকে শেষ করিতে দিয়া তাহার পরে দণ্ড দিবেন।”

 আশাও বিনোদিনীকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িল। ছবি লওয়া হইল। কিন্তু প্রথম ছবিটা খারাপ হইয়া গেল। সুতরাং পরের দিন আর-একটা ছবি না লইয়া চিত্রকর ছাড়িল না। তার পরে আবার দুই সখীকে একত্র করিয়া বন্ধুত্বের চিরনিদর্শনস্বরূপ