পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৮
চোখের বালি

 বিনোদিনী অত্যন্ত টিপিয়া হাসিল— কহিল, “আপনি যখন দেওর তখন সম্পর্কের যে জোর আছে; যেখানে দাবি করা চলে সেখানে ভিক্ষা করা কেন। আদর যে কাড়িয়া লইতে পারেন! কী বলেন মহেন্দ্রবাবু।”

 মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফুর্তি হইতেছিল না।

 বিনোদিনী। বিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া? আর কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে?

 বিহারী। কোনো দরকার নাই। যাহা পাইলাম, তাহাই প্রচুর।

 বিনোদিনী। ঠাট্টাা? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাই। মিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না।


 রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্রকাশ করিল— মহেন্দ্র অন্য দিনের মতো হাসিয়া উড়াইয়া দিল না, সম্পূর্ণ যোগ দিল।

 প্রাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি গেল। কহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির মেয়ে নয়— তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়।”

 বিহারী কহিল, “তাই নাকি! তবে তো কাজটা ভালো হয় না। তিনি যদি আপত্তি করেন, তার সামনে নাই গেলাম।”

 মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইল। এত সহজে এই অপ্রিয় কার্য শেষ হইবে তাহা সে মনে করে নাই। বিহারীকে মহেন্দ্র ভয় করে।

 সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মাপ করিতে হইবে।”

 বিনোদিনী। কেন বিহারীবাবু।

 বিহারী। মহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত হইয়াছেন; তাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব।

 বিনোদিনী। সে কি হয় বিহারীবাবু। আমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্য কেন যাইবেন। এত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না। এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ ম্লান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

 বিহারী ক্ষণকালের জন্য মনে করিল, “মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি।’