পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬২
চোখের বালি

 মহেন্দ্র মুখ ভার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, এক কাজ করা যাক। আমি একটা আলাদা গাড়ি ভাড়া করিয়া যাই, বিহার ভিতরে আসিয়া বসুক।”

 আশা কহিল,”তা যদি হয়, তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাইব।”

 বিনোদিনী কহিল, “আর আমি বুঝি গাড়ি হইতে লাফাইয়া পড়িব?”

 এমনি গোলমাল করিয়া কথাটা থামিয়া গেল।

 মহেন্দ্র সমস্ত পথ মুখ অত্যন্ত গভীর করিয়া রহিল।

 দমদমের বাগানে গাড়ি পৌঁছিল। চাকরদের গাড়ি অনেক আগে ছাড়িয়াছিল, কিন্তু এখনো তাহার খোঁজ নাই।

 শরৎকালের প্রাতঃকাল অতি মধুর। রৌদ্র উঠিয়া শিশির মরিয়া গেছে, কিন্তু গাছপালা নির্মল আলোকে ঝল্মল্ করিতেছে। প্রাচীরের গায়ে শেফালি গাছের সারি রহিয়াছে, তলদেশ ফুলে আচ্ছন্ন এবং গন্ধে আমোদিত।

 আশা কলিকাতার ইষ্টকবন্ধন হইতে বাগানের মধ্যে ছাড়া পাইয়া বন্য মৃগীর মতো উল্লসিত হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে লইয়া রাশীকৃত ফুল কুড়াইল, গাছ হইতে পাকা আতা পাড়িয়া আতা গাছের তলায় বসিয়া খাইল, দুই সখীতে দিঘির জলে পড়িয়া দীর্ঘকাল ধরিয়া স্নান করিল। এই দুই নারীতে মিলিয়া একটি নিরর্থক আনন্দে গাছের ছায়া এবং শাখাচ্যুত আলোক, দিঘির জল এবং নিকুঞ্জের পুষ্পপল্লবকে পুলকিত সচেতন করিয়া তুলিল।

 স্নানের পর দুই সখী আসিয়া দেখিল, চাকরদের গাড়ি তখনো আসিয়া পৌঁছে নাই। মহেন্দ্র বাড়ির বারান্দায় চৌকি লইয়া অত্যন্ত শুষ্কমুখে একটা বিলাতি দোকানের বিজ্ঞাপন পড়িতেছে।

 বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারীবাবু কোথায়।”

 মহেন্দ্র সংক্ষেপে উত্তর করিল, “জানি না।”

 বিনোদিনী। চলুন, তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করি গে।

 মহেন্দ্র। তাহাকে কেহ চুরি করিয়া লইবে, এমন আশঙ্কা নাই। না খুঁজিলেও পাওয়া যাইবে।

 বিনোদিনী। কিন্তু, তিনি হয়তো আপনার জন্য ভাবিয়া মরিতেছেন, পাছে দুর্লভ রত্ন খোওয়া যায়; তাঁহাকে সাত্বনা দিয়া আসা যাক।

 জলাশয়ের ধারে প্রকাণ্ড একটা বাঁধানো বটগাছ আছে, সেইখানে বিহারী তাহার প্যাক্বাক্স খুলিয়া একটি কেরোসিন-চুলা বাহির করিয়া জল গরম করিতেছে। সকলে আসিবা মাত্র আতিথ্য করিয়া বাঁধা বেদির উপর বসাইয়া এক-এক পেয়ালা