পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬
চোখের বালি

পড়িলেন। রোগ গুরুতর নহে, তবু তাহার অসুখ ও দুর্বলতা যথেষ্ট। বিনোদিনী দিনরাজি তাঁহার সেবায় নিযুক্ত হইল।

 মহেন্দ্র কহিল, ‘দিনরাত এমন করিয়া থাকিলে শেষকালে তুমিই যে অসুখে পড়িবে। মার সেবার জন্যে আমি লোক ঠিক করিয়া দিতেছি।”

 বিহারী কহিল, “মহিনদা, তুমি অত ব্যস্ত হইয়ো না। উনি সেবা করিতেছেন, করিতে দাও। এমন করিয়া কি আর কেহ করিতে পারিবে।”

 মহেন্দ্র রোগীর ঘরে ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিল। একটা লোক কোনো কাজ করিতেছে না, অথচ কাজের সময় সর্বদাই সঙ্গে লাগিয়া আছে, ইহা কর্মিষ্ঠা বিনোদিনীর পক্ষে অসহ্য। সে বিরক্ত হইয়া দু-তিন বার কহিল, “মহিনবাবু, আপনি এখানে বসিয়া থাকিয়া কী সুবিধা করিতেছেন। আপনি যান— অনর্থক কালেজ কামাই করিবেন না।”

 মহেন্দ্র তাহাকে অনুসরণ করে, ইহাতে বিনোদিনীর গর্ব এবং সুখ ছিল, কিন্তু তাই বলিয়া এমনতরো কাঙালপনা, রুগ্ণা মাতার শয্যাপার্শ্বেও লুব্ধহৃদয়ে বসিয়া থাকা— ইহাতে তাহার ধৈর্য থাকিত না, ঘৃণাবোধ হইত। কোনো কাজ যখন বিনোদিনীর উপর নির্ভর করে তখন সে আর কিছুই মনে রাখে না। যতক্ষণ খাওয়ানো-দাওয়ানো, রোগীর সেবা, ঘরের কাজ প্রয়োজন, ততক্ষণ বিনোদিনীকে কেহ অনবধান দেখে নাই— সেও প্রয়োজনের সময় কোনোপ্রকার অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার দেখিতে পারে না।

 বিহারী অল্পক্ষণের জন্য মাঝে মাঝে রাজলক্ষ্মীর সংবাদ লইতে আসে। ঘরে ঢুকিয়াই, কী দরকার তাহা সে তখনই বুঝিতে পারে; কোথায় একটা-কিছুর অভাব আছে তাহা তাহার চোখে পড়ে; মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ঠিক করিয়া দিয়া সে বাহির হইয়া যায়। বিনোদিনী মনে বুঝিতে পারিত, বিহারী তাহার শুশ্রুষাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেছে। সেইজন্য বিহারীর আগমনে সে যেন বিশেষ পুরস্কার লাভ করিত।

 মহেন্দ্র নিতান্ত ধিক্কারবেগে অত্যন্ত কড়া নিয়মে কালেজে বাহির হইতে লাগিল। একে তাহার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ হইয়া রহিল, তাহার পরে এ কী পরিবর্তন। খাবার ঠিক সময়ে হয় না, সইসটা নিরুদেশ হয়, মোজাজোড়ার ছিদ্র ক্রমেই অগ্রসর হইতে থাক। এখন এই সমস্ত বিশৃঙ্খলায় মহেন্দ্রে পূর্বের ন্যায় আমোদ বোধ হয় না। যখন যেটি দরকার তখনই সেটি হাতের কাছে সুসজ্জিত পাইবার আরাম কাহাকে বলে, তাহা সে কয়দিন জানিতে পারিয়াছে। এক্ষণে তাহার অভাবে, আশার অশিক্ষিত অপটুতায় মহেন্দ্রে আর কৌতুক বোধ হয় না।—