পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৬৭

 “চুনি, আমি তোমাকে কতদিন বলিয়াছি, স্নানের আগেই আমার জামায় বোতাম পরাইয়া প্রস্তুত রাখিবে, আর আমার চাপকান-প্যাণ্টলুন ঠিক করিয়া রাখিয়া দিবে— একদিনও তাহা হয় না। স্নানের পর বোতাম পরাইতে আর কাপড় খুঁজিয়া বেড়াইতে আমার দু ঘণ্টা যায়।”

 অনুতপ্ত আশা লজ্জায় মান হইয়া বলে, “আমি বেহারাকে বলিয়া দিয়াছিলাম।”

 “বেহারাকে বলিয়া দিয়াছিলে! নিজের হাতে করিতে দোষ কী। তোমার দ্বারা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়!”

 ইহা আশার পক্ষে বজ্রাঘাত। এমন ভর্ৎসনা সে কখনো পায় নাই। এ জবাব তাহার মুখে বা মনে আসিল না যে, ‘তুমিই তো আমার কর্মশিক্ষার ব্যাঘাত করিয়াছ।’ এ ধারণাই তাহার ছিল না যে, গৃহকর্মশিক্ষা নিয়ত অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা-সাপেক্ষ। সে মনে করিত, ‘আমার স্বাভাবিক অক্ষমতা ও নিরবুদ্ধিতাবশতই কোনো কাজ ঠিকমত করিয়া উঠিতে পারি না।’ মহেন্দ্র যখন আত্মবিস্মৃত হইয়া বিনোদিনীর সহিত তুলনা দিয়া আশাকে ধিক্কার দিয়াছে তখন সে তাহা বিনয়ে ও বিনা বিদ্বেযে গ্রহণ করিয়াছে।

 আশা এক-একবার তাহার রুগ্ণা শাশুড়ির ঘরের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়, এক-একবার লজ্জিতভাবে ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। সে নিজেকে সংসারের পক্ষে আবশ্যক করিয়া তুলিতে ইচ্ছা করে; সে কাজ দেখাইতে চায়, কিন্তু কেহ তাহার কাজ চাহে না। সে জানে না কেমন করিয়া কাজের মধ্যে প্রবেশ করা যায়, কেমন করিয়া সংসারের মধ্যে স্থান করিয়া লইতে হয়। সে নিজের অক্ষমতার সংকোচে বাহিরে বাহিরে ফিরে। তাহার কী একটা মনোবেদনার কথা অন্তরে প্রতিদিন বাড়িতেছে, কিন্তু তাহার সেই অপরিস্ফুট বেদনা, সেই অব্যক্ত আশঙ্কাকে সে স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে না। সে অনুভব করে, তাহার চারিদিকের সমস্তই সে যেন নষ্ট করিতেছে— কিন্তু কেমন করিয়াই যে তাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল, এবং কেমন করিয়াই যে তাহা নষ্ট হইতেছে, এবং কেমন করিলে যে তাহার প্রতিকার হইতে পারে, তাহা সে জানে না। থাকিয়া থাকিয়া কেবল গলা ছাড়িয়া কাঁদিয়া বলিতে ইচ্ছা করে, ‘আমি অত্যন্ত অযোগ্য, নিতান্ত অক্ষম, আমার মূঢ়তার কোথাও তুলনা নাই।’

 পূর্বে তো আশা ও মহেন্দ্র সুদীর্ঘকাল দুইজনে এক গৃহকোণে বসিয়া কখনো কথা কহিয়া, কখনো কথা না কহিয়া, পরিপূর্ণ মুখে সময় কাটাইয়াছে। আজকাল বিনোদিনীর অভাবে আশার সঙ্গে একলা বসিয়া মহেন্দ্রের মুখে কিছুতেই যেন সহজে