পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৮
চোখের বালি

কথা জোগায় না— এবং কিছু না কহিয়া চুপ করিয়া থাকিতেও তাহার বাধো-বাধে ঠেকে।


 মহেন্দ্র বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ও চিঠি কাহার।”

 “বিহারীবাবুর।”

 “কে দিল।”

 “বহুঠাকুরানী।” (বিনোদিনী)

 “দেখি” বলিয়া চিঠিখানা লইল। ইচ্ছা হইল ছিঁড়িয়া পড়ে। দু-চারি বার উল্টাপাল্টা করিয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া বেহারার হাতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। যদি চিঠি খুলিত তবে দেখিত, তাহাতে লেখা আছে ‘পিসিমা কোনোমতেই সাগু-বার্লি খাইতে চান না, আজ কি তাঁহাকে ডালের ঝোল খাইতে দেওয়া হইবে।’ ঔষধপথ্য লইয়া বিনোদিনী মহেন্দ্রকে কখনো কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিত না, সে সম্বন্ধে বিহারীর প্রতিই তাহার নির্ভর।

 মহেন্দ্র বারান্দায় খানিকক্ষণ পায়চারি করিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দড়ি ছিন্নপ্রায় হওয়াতে ছবিটা বাঁকা হইয়া আছে। আশাকে অত্যন্ত ধমক দিয়া কহিল, “তোমার চোখে কিছুই পড়ে না, এমনি করিয়া সমস্ত জিনিস নষ্ট হইয়া যায়।”

 দমদমের বাগান হইতে ফুল সংগ্রহ করিয়া যে তোড়া বিনোদিনী পিতলের ফুলদানিতে সাজাইয়া রাখিয়াছিল, আজও তাহা শুষ্ক অবস্থায় তেমনি ভাবে আছে; অন্যদিন মহেন্দ্র এ-সমস্ত লক্ষ্যই করে না, আজ তাহা চোখে পড়িল। কহিল, “বিনোদিনী আসিয়া না ফেলিয়া দিলে ও আর ফেলাই হইবে না।”

 বলিয়া ফুলসুদ্ধ ফুলদানি বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিল, তাহা ঠংঠং শব্দে সিঁড়ি দিয়া গড়াইয়া চলিল। ‘কেন আশা আমার মনের মতো হইতেছে না; কেন সে আমার মনের মতো কাজ করিতেছে না; কেন তাহার স্বভাবগত শৈথিল্য ও দুর্বলতায় সে আমাকে দাম্পত্যের পথে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া রাখিতেছে না, সর্বদা আমাকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিতেছে!’—এই কথা মহেন্দ্র মনে মনে আন্দোলন করিতে করিতে হঠাৎ দেখিল, আশার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেছে, সে খাটের থাম ধরিয়া আছে, তাহার ঠোটদুটি কাঁপিতেছে—কাঁপিতে কাঁপিতে সে হঠাৎ বেগে পাশের ঘর দিয়া চলিয়া গেল।

 মহেন্দ্র তখন ধীরে ধীরে গিয়া ফুলদানিটা কুড়াইয়া আনিয়া রাখিল। ঘরের