পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭২
চোখের বালি

দুয়েরই মিশ্রণ বিনোদিনী তাহা ভাবিয়া পায় না। মনে মনে তীব্র হাসি হাসিয়া বলে, ‘কোনো নারীর কি আমার মতো এমন দশা হইয়াছে। আমি মরিতে চাই কি মারিতে চাই তাহা বুঝিতেই পারিলাম না।’ কিন্তু যে কারণেই বল, দগ্ধ হইতেই হউক বা দগ্ধ করিতেই হউক, মহেন্দ্রকে তাহার একান্ত প্রয়োজন। সে তাহার বিষদিগ্ধ অগ্নিবান জগতে কোথায় মোচন করিবে। ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বিনোদিনী কহিল, ‘সে যাইবে কোথায়; সে ফিরিবেই। সে আমার!’

 আশা ঘর পরিষ্কার করিবার ছুতা করিয়া সন্ধ্যার সময়ে মহেন্দ্রের বাহিরের ঘরে, মাথায়-তেলে-দাগ-পড়া মহেন্দ্রের বসিবার কেদারা, কাগজপত্র-ছড়ানো ডেস্ক, তাহার বই, তাহার ছবি প্রভৃতি জিনিসপতির বারবার নাড়াচড়া এবং অঞ্চল দিয়া ঝাড়পোঁচ করিতেছিল। এইরূপ মহেন্দ্রের সকল জিনিস নানারূপে স্পর্শ করিয়া, একবার রাখিয়া, একবার তুলিয়া, আশার বিরহসন্ধ্যা কাটিতেছিল। বিনোদিনী ধীরে ধীরে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; আশা ঈষৎ লজ্জিত হইয়া তাহার নাড়াচড়ার কাজ রাখিয়া দিয়া, কী যেন খুঁজিতেছে এমনিতরো ভান করিল। বিনোদিনী গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাস করিল, “কী হচ্ছে তোর, ভাই।”

 আশা মুখে একটুখানি হাসি জাগাইয়া কহিল, “কিছুই না, ভাই।”

 বিনোদিনী তখন আশার গলা জড়াইয়া কহিল, “কেন ভাই বালি, ঠাকুরপো এমন করিয়া চলিয়া গেলেন কেন।”

 আশা বিনোদিনীর এই প্রশ্নমাত্রেই সংশয়ান্বিত সশঙ্কিত হইয়া উত্তর করিল, “তুমি তো জানই ভাই, কলেজে তাঁহার বিশেষ কাজ পড়িয়াছে বলিয়া গেছেন।”

 বিনোদিনী ডান হাতে আশার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া যেন করুণায় বিগলিত হইয়া স্তব্ধভাবে একবার তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।

 আশার বুক দমিয়া গেল। নিজেকে সে নির্বোধ এবং বিনোদিনীকে বুদ্ধিমতী বলিয়া জানিত। বিনোদিনীর ভাবখানা দেখিয়া হঠাৎ তাহার বিশ্বসংসার অন্ধকার হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে স্পষ্ট করিয়া কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাস করিতে সাহস করিল না। দেওয়ালের কাছে একটা সোফার উপরে বসিল। বিনোদিনীও তাহার পাশে বসিয়া দৃঢ় বাহু দিয়া আশাকে বুকের কাছে বাঁধিয়া ধরিল। সখীর সেই আলিঙ্গনে আশা আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, তাহার দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দ্বারের কাছে অন্ধ ভিখারী খঞ্জনি বাজাইয়া গাহিতেছিল, ‘চরণতরণী দে মা, তারিণী তারা।’