পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
চোখের বালি

 বুঝিতে পারিলাম না— ঘরে থাকিয়াও কি তুমি আমাকে ফেলিতে পারিতে না। আমার জন্যও কি তোমার ঘর ছাড়িয়া যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল। আমি কি তোমার এতখানি জুড়িয়া আছি। আমাকে তোমার ঘরের কোণে, তোমার দ্বারের বাহিরে ফেলিয়া রাখিলেও কি আমি তোমার চোখে পড়িতাম। তাই যদি হয়, তুমি কেন গেলে, আমার কি কোথাও যাইবার পথ ছিল না। ভাসিয়া আসিয়াছি, ভাসিয়া যাইতাম—

 এ কী চিঠি। এ ভাষা কাহার তাহা মহেন্দ্রের বুঝিতে বাকি রহিল না। অকস্মাৎ আহত মূৰ্ছিতের মতো মহেন্দ্র সে চিঠিখানি লইয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল। যে লাইনে রেলগাড়ির মতো তাহার মন পূর্ণবেগে ছুটিয়াছিল, সেই লাইনের বিপরীত দিক হইতে একটা ধাক্কা খাইয়া লাইনের বাহিরে তাহার মনটা যেন উল্টাপাল্টা স্তূপাকার বিকল হইয়া পড়িয়া থাকিল।

 অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া আবার সে দুইবার তিনবার করিয়া পড়িল। কিছুকাল যাহা সুদূর আভাসের মতো ছিল, আজ তাহা যেন ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার জীবনাকাশের এক কোণে যে ধূমকেতুটা ছায়ার মতো দেখাইতেছিল, আজ তাহার উদ্যত বিশাল পুচ্ছ অগ্নিরেখায় দীপ্যমান হইয়া দেখা দিল।

 এ চিঠি বিনোদিনীরই। সরলা আশা নিজের মনে করিয়া তাহা লিখিয়াছে। পূর্বে যে কথা সে কখনো ভাবে নাই, বিনোদিনীর রচনামত চিঠি লিখিতে গিয়া সেই-সব কথা তাহার মনে জাগিয়া উঠিতে লাগিল। নকল-করা কথা বাহির হইতে বদ্ধমূল হইয় তাহার আন্তরিক হইয়া গেল; যে নূতন বেদনার সৃষ্টি হইল, এমন সুন্দর করিয়া তাহা ব্যক্ত করিতে আশা কখনোই পারিত না। সে ভাবিতে লাগিল, ‘সখী আমার মনের কথা এমন ঠিকটি বুঝিল কী করিয়া। কেমন করিয়া এমন ঠিকটি প্রকাশ করিয়া বলিল।’ অন্তরঙ্গ সখীকে আশা আরো যেন বেশি আগ্রহের সঙ্গে আশ্রয় করিয়া ধরিল; কারণ, যে ব্যথাটা তাহার মনের মধ্যে, তাহার ভাষাটি তাহার সখীর কাছে— সে এতই নিরুপায়।

 মহেন্দ্র চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া, বিনোদিনীর উপর রাগ করিতে অনেক চেষ্টা করিল; মাঝে থেকে রাগ হইল আশার উপর; ‘দেখো দেখি, আশার এ কী মূঢ়তা, স্বামীর প্রতি এ কী অত্যাচার।’ বলিয়া চৌকিতে বসিয়া পড়িয়া প্রমাণস্বরূপ চিঠিখানা আবার পড়িল। পড়িয়া ভিতরে ভিতরে একটা হর্ষসঞ্চার হইতে লাগিল। চিঠিখানাকে সে আশারই চিঠি মনে করিয়া পড়িবার অনেক চেষ্টা করিল। কিন্তু এ ভাষায় কোনোমতেই সরলা আশাকে মনে করাইয়া দেয় না। দু-