পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৭৭

চার লাইন পড়িবা মাত্র একটা সুখোন্মাদকর সন্দেহ ফেনিল মদের মতো মনকে চারি দিকে ছাপাইয়া উঠিতে থাকে। এই প্রচ্ছন্ন অথচ ব্যক্ত, নিষিদ্ধ অথচ নিকটাগত, বিষাক্ত অথচ মধুর, একই কালে উপহৃত অথচ প্রত্যাহত, প্রেমের আভাস মহেন্দ্রকে মাতাল করিয়া তুলিল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, নিজের হাতে পায়ে কোথাও এক জায়গায় ছুরি বসাইয়া বা আর-কিছু করিয়া নেশা ছটাইয়া মনটাকে আর-কোনো দিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। টেবিলে সজোরে মুষ্টি বসাইয়া চৌকি হইতে লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, ‘দূর করো, চিঠিখানা পুড়াইয়া ফেলি।’ বলিয়া চিঠিখানি ল্যাম্পের কাছাকাছি লইয়া গেল। পুড়াইল না, আর-একবার পড়িয়া ফেলিল। পরদিন ভৃত্য টেবিল হইতে কাগজপোড়া ছাই অনেক ঝাড়িয়া ফেলিয়াছিল। কিন্তু তাহা আশার চিঠির ছাই নহে, চিঠির উত্তর দিবার অনেকগুলা অসম্পূর্ণ চেষ্টাকে মহেন্দ্র পুড়াইয়া ছাই করিয়াছে।

২১

ইতিমধ্যে আরো এক চিঠি আসিয়া উপস্থিত হইল—

  তুমি আমার চিঠির উত্তর দিলে না? ভালোই করিয়াছ। ঠিক কথা তো লেখা যায় না; তোমার যা জবাব, সে আমি মনে মনে বুঝিয়া লইলাম। ভক্ত যখন তার দেবতাকে ডাকে, তিনি কি মুখের কথায় তাহার উত্তর দেন। দুখিনীর বিল্বপত্রখানি চরণতলে বোধ করি স্থান পাইয়াছে।

  কিন্তু ভক্তের পূজা লইতে গিয়া শিবের যদি তপোভঙ্গ হয়, তবে তাহাতে রাগ করিয়ো না, হৃদয়দেব! তুমি বর দাও বা না দাও, চোখ মেলিয়া চাও বা না চাও, জানিতে পার বা না পার, পূজা না দিয়া ভক্তের আর গতি নাই। তাই আজিও এই দু-ছত্র চিঠি লিখিলাম— হে আমার পাষাণ-ঠাকুর, তুমি অবিচলিত হইয়া থাকো।

 মহেন্দ্র আবার চিঠির উত্তর লিখিতে প্রবৃত্ত হইল। কিন্তু আশাকে লিখিতে গিয়া বিনোদিনীর উত্তর কলমের মুখে আপনি আসিয়া পড়ে। ঢাকিয়া লুকাইয়া কৌশল করিয়া লিখিতে পারে না। অনেকগুলি ছিঁড়িয়া, রাত্রের অনেক প্রহর কাটাইয়া একটা যদি বা লিখিল, সেটা লেফাফায় পুরিয়া উপরে আশার নাম লিখিবার সময় হঠাৎ তাহার পিঠে যেন কাহার চাবুক পড়িল; কে যেন বলিল, ‘পাষণ্ড, বিশ্বস্ত বালিকার প্রতি এমনি করিয়া প্রতারণা!' চিঠি মহেন্দ্র সহস্র টুকরা