পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৯
চোখের বালি

মনে মনে কহিল, ‘নিজে অন্যায় করা হইল, আবার আমার উপর রাগ! এমন সাধু তো দেখি নাই! কিন্তু, এমন সাধুত্ব বেশি দিন টে’কে না।’


২৩

 সংসারত্যাগিনী অন্নপূর্ণা বহুদিন পরে হঠাৎ মহেন্দ্রকে আসিতে দেখিয়া যেমন স্নেহে আনন্দে আপ্লুত হইয়া গেলেন, তেমনি তাঁহার হঠাৎ ভয় হইল, বুঝি আশাকে লইয়া মার সঙ্গে মহেন্দ্রের আবার কোনো বিরোধ ঘটিয়াছে এবং মহেন্দ্র তাঁহার কাছে নালিশ জানাইয়া সান্ত্বনালাভ করিতে আসিয়াছে। মহেন্দ্র শিশুকাল হইতেই সকলপ্রকার সংকট ও সন্তাপের সময় তাহার কাকীর কাছে ছুটিয়া আসে। কাহারো উপর রাগ করিলে অন্নপূর্ণা তাহার রাগ থামাইয়া দিয়াছেন, দুঃখবোধ করিলে তাহা সহজে সহ্য করিতে উপদেশ দিয়াছেন। কিন্তু বিবাহের পর হইতে মহেন্দ্রের জীবনে সর্বাপেক্ষ যে সংকটের কারণ ঘটিয়াছে, তাহার প্রতিকারচেষ্টা দূরে থাক, কোনোপ্রকার সান্ত্বনা পর্যন্ত তিনি দিতে অক্ষম। সে সম্বন্ধে যেভাবে যেমন করিয়াই তিনি হস্তক্ষেপ করিবেন, তাহাতেই মহেন্দ্রের সাংসারিক বিপ্লব আরো দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিবে, ইহাই যখন নিশ্চয় বুঝিলেন তখনই তিনি সংসার ত্যাগ করিলেন। রুগ্ণ শিশু যখন জল চাহিয়া কাঁদে, এবং জল দেওয়া যখন কবিরাজের নিতান্ত নিষেধ, তখন পীড়িতচিত্তে মা যেমন অন্য ঘরে চলিয়া যান,অন্নপূর্ণা তেমনি করিয়া নিজেকে প্রবাসে লইয়। গেছেন। দূর তীর্থবাসে থাকিয়া ধর্মকর্মের নিয়মিত অনুষ্ঠানে এ কয়দিন সংসার অনেকটা ভুলিয়াছিলেন, মহেন্দ্র আবার কি সেই-সকল বিরোধের কথা তুলিয়া তাহার প্রচ্ছন্ন ক্ষতে আঘাত করিতে আসিয়াছে।

 কিন্তু মহেন্দ্র আশাকে লইয়া তাহার মা’র সম্বন্ধে কোনো নালিশের কথা তুলিল ন। তখন অন্নপূর্ণার আশঙ্ক। অন্য পথে গেল। যে মহেন্দ্র আশাকে ছাড়িয়া কলেজে যাইতে পারিত না, সে আজ কাকীর খোঁজ লইতে কাশী আসে কেন। তবে কি আশার প্রতি মহেন্দ্রের টান ক্রমে ঢিলা হইয়া আসিতেছে। মহেন্দ্রকে তিনি কিছু আশঙ্কার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ রে মহিন, আমার মাথা খা, ঠিক করিয়া বল্ দেখি, চুনি কেমন আছে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “সে তো বেশ ভালো আছে, কাকীমা।”

 “আজকাল সে কী করে মহিন। তোরা কি এখনো তেমনি ছেলেমানুষ আছিস, না, কাজকর্মে ঘরকন্নায় মন দিয়াছিস।”

 মহেন্দ্র কহিল, “ছেলেমানুষি একেবারেই বন্ধ। সকল ঝঞ্ঝাটের মূল সেই চারু-