পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২২
ছন্দ

 [একদিন এই তত্ত্বটি বিশেষ করে আমার গোচর হয়েছিল, তার ইতিহাসটা বলি।

 সংস্কৃত ভাষায় প্রত্যেক শব্দেই দীর্ঘহ্রস্বধ্বনির অসাম্য, ইংরেজি ভাষায় ধ্বনির অসমানতা তার এক্‌সেন্‌ট্‌বিদ্ধ শব্দে। মসৃণপথে তারা গড়গড় করে গড়িয়ে যায় না, ধাক্কা দিতে দিতে মনের মধ্যে দাগ রেখে রেখে চলে। বাংলাভাষায় রেলপাতা পথে ঠেলাগাড়ির মতো শব্দগুলোকে এক ঝোঁকে আট-দশ মাত্রা অনায়াসে পিছলিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে, মনের মধ্যে তারা জোরে দাগ কাটে না; যথেষ্ট সময় পায় না নিজেকে বিশেষ করে জানান দেবার।[১] এই ত্রুটি লাঘব করবার জন্যে মাইকেল তাঁর অমিত্রাক্ষর ছন্দে যুক্তবর্ণের ধ্বনি পদে পদে ঝংকৃত করে পয়ারের একটানা চালের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করেছিলেন। সাধারণ পয়ারে এই শক্তির সম্ভাবনা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় সে তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন। তৎসত্ত্বেও তাঁর অনবধানতা ‘মেঘনাদবধ’কাব্যের আরম্ভেই প্রকাশ পেয়েছে।

সম্মুখ-সময়ে পড়ি বীরচূড়ামণি
বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতিপদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি।

এতগুলি পংক্তির আরম্ভে ও শেষে দুটিমাত্র যুক্তবর্ণের ধাক্কা। এর সঙ্গে ‘প্যারাডাইস্ লস্‌ট্’এর সূচনা মিলিয়ে দেখলে প্রভেদ স্পষ্ট হবে।

 একদিন তৎকালপ্রচলিত বাংলা ছন্দের ক্ষীণতা-প্রতিকারের উপায় আমাকে ভাবতে হয়েছিল। সংস্কৃতের অনুকরণে বাংলা স্বরবর্ণে হ্রস্বদীর্ঘতার প্রচলন করতে গেলে এই কৃত্রিমতা বেশিক্ষণ সয় না। তার

  1. দ্রষ্টব্য পৃ ১-২, ৮-৯।