চলতিভাষার ছন্দ
মানুষের উদ্ভাবনী-প্রতিভার একটা কীর্তি হল চাকা বানানো। চাকার সঙ্গে একটা নতুন চলৎশক্তি এল তার সংসারে। বস্তুর বোঝা সহজে নড়ে না, তাকে পরস্পরের মধ্যে চালাচালি করতে দুঃখ পেতে হয়। চাকা সেই জড়ত্বের মধ্যে প্রাণ এনে দিলে। আদানপ্রদানের কাজ চলল বেগে। ভাষার দেশে সেই চাকা এসেছে ছন্দের রূপে। সহজ হল মোটবাঁধা কথাগুলিকে চালিয়ে দেওয়া। মুখে-মুখে চলল ভাষার দেনাপাওনা।
কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা। সে শেষ হয়েও শেষ হয় না। গদ্যে যখন বলি “একদিন শ্রাবণের রাত্রে বৃষ্টি পড়েছিল,” তখন এই বলার মধ্যে এই খবরটা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু কবি যখন বললেন
রজনী শাঙনঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে
তখন কথা থেমে গেলেও বলা থামে না।[১] এ-বৃষ্টি যেন নিত্যকালের বৃষ্টি, পঞ্জিকা-আশ্রিত কোনো দিনক্ষণের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এ-বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যায়নি। এই খবরটির উপর ছন্দ যে-দোলা সৃষ্টি করে দেয় সে-দোলা ঐ খবরটিকে প্রবহমান করে রাখে।
অণুপরমাণু থেকে আরম্ভ করে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত সর্বত্রই নিরন্তর গতিবেগের মধ্যে ছন্দ রয়েছে। বস্তুত এই ছন্দই রূপ। উপাদানকে ছন্দের মধ্যে তরঙ্গিত করলেই সৃষ্টি রূপ ধারণ করে। ছন্দের বৈচিত্র্যই রূপের বৈচিত্র্য। বাতাস যখন ছন্দে কাঁপে তখনি সে সুর হয়ে ওঠে।
- ↑ দ্রষ্টব্য ৩৩ পৃষ্ঠা।