পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গদ্য ছন্দ
১৫৩

ছন্দের ভঙ্গি এসে পৌঁছেছে অথচ কোনো বিশেষ ছন্দের কাঠামো নেই। এর গদ্য সমমাত্রায় বিভক্ত নয়, কিন্তু শিল্পপ্রচেষ্টা আছে এর গতির মধ্যে।

 গদ্যসাহিত্যে এই যে বিচিত্রমাত্রার ছন্দ মাঝে-মাঝে উচ্ছ্বসিত হয়, সংস্কৃত বিশেষত প্রাকৃত আর্যা প্রভৃতি ছন্দে তার তুলনা মেলে। সে-সকল ছন্দে সমান পদক্ষেপের নৃত্য নেই, বিচিত্র-পরিমাণ ধ্বনিপুঞ্জ কানকে আঘাত করতে থাকে। যজুর্বেদের গদ্যমন্ত্রের ছন্দকে ছন্দ বলেই গণ্য করা হয়েছে। তার থেকে দেখা যায় প্রাচীনকালেও ছন্দের মূলতত্ত্বটি গদ্যে পদ্যে উভয়ত্রই স্বীকৃত। অর্থাৎ যে পদবিভাগ বাণীকে কেবল অর্থ দেবার জন্যে নয়, তাকে গতি দেবার জন্যে, তা সমমাত্রার না হলেও তাতে ছন্দের স্বভাব থেকে যায়।

 পদ্যছন্দের প্রধান লক্ষণ পংক্তিসীমানায় বিভক্ত তার কাঠামো। নির্দিষ্টসংখ্যক ধ্বনিগুচ্ছে এক-একটি পংক্তি সম্পূর্ণ। সেই পংক্তিশেষে একটি করে বড়ো যতি। বলা বাহুল্য গদ্যে এই নিয়মের শাসন নেই। গদ্যে বাক্য যেখানে আপন অর্থ সম্পূর্ণ করে সেইখানেই তার দাঁড়াবার জায়গা। পদ্যছন্দ যেখানে আপন ধ্বনিসংগতিকে অপেক্ষাকৃত বড়ো রকমের সমাপ্তি দেয়, অর্থনির্বিচারে সেইখানে পংক্তি শেষ করে। পথ সর্বপ্রথমে এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে অমিত্রাক্ষর ছন্দে, পংক্তির বাইরে পদচারণা শুরু করলে। আধুনিক পদ্যে এই স্বৈরাচার দেখা দিল পয়ারকে আশ্রয় করে।[১]

 বলা বাহুল্য এক মাত্র। চলে না। বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ। যেই দুইয়ের সমাগম অমনি হল চলা শুরু। থাম আছে এক পায়ে

  1. পদ্যে পংক্তিসীমালঙ্ঘনের রীতি কেন পয়ারেই দেখা দিল তা ব্যাখ্যাত হয়েছে ৪৪-৪৫ ও ৬৮-৬৯ পৃষ্ঠায়। বস্তুত এই প্রবন্ধটি যখন ‘বঙ্গশ্রী’তে প্রকাশিত হয়। তখন ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠার ‘পয়ার ছন্দের বিশেষত্ব ... রক্ষঃকুলনিধি রাখবারি’ এই অংশটুকুকে ঈবৎ-পরিবর্তিতরূপে ‘আশ্রর করে’র পরে সন্নিবেশ করা হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এই অংশটা বর্জিত হয়।