পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলা শব্দ ও ছন্দ
১৭৩

এই দুটি ছত্রে অক্ষরের গুরুলঘু নিরূপিত হওয়াতে এই সামান্য গুটিকয়েক কথার মধুর ভাবে সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়া লয়। কিন্তু এই ভাব সমমাত্রক[১] ছন্দে নিবিষ্ট হইলে অনেকটা নিষ্ফল হইয়া পড়ে। যেমন—

মৃদুল পবন, কুসুমকানন,
ফুলপরিমল-মাধুরী।

 ইংরেজিতে অনেক সময় আট-দশ লাইনের একটি ছোটো কবিতা লঘুবাণের মতো ক্ষিপ্রগতিতে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া মর্মের মধ্যে বিদ্ধ হইয়া থাকে। বাংলায় ছোটো কবিতা আমাদের হৃদয়ের স্বাভাবিক জড়তায় আঘাত দিতে পারে না। বোধ করি কতকটা সেই কারণে আমাদের ভাষার এই খর্বতা আমরা অত্যুক্তি দ্বারা পূরণ করিয়া লইতে চেষ্টা করি।[২] একটা কথা বাহুল্য করিয়া না বলিলে আমাদের ভাষায় বড়োই ফাঁকা শুনায় এবং সে কথা কাহারো কানে পৌঁছায় না। সেইজন্য সংক্ষিপ্ত সংহত রচনা আমাদের দেশে প্রচলিত নাই বলিলেই হয়। কোনো লেখা অত্যুক্তি পুনরুক্তি বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং আড়ম্বরপূর্ণ না হইলে সাধারণত গ্রাহ্য হয় না।

 বাংলা পড়িবার সময় অনেক পাঠক অধিকাংশ স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করিয়া টানিয়া টানিয়া পড়েন।[৩] নচেৎ সমমাত্র হ্রস্বস্বরে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ কুলাইয়া উঠে না। বাংলার বক্তারা অনেকেই দীর্ঘ উচ্চারণ প্রয়োগ করিয়া বক্তৃতা বৃহৎ ও গম্ভীর করিয়া তোলেন। ভালো ইংরেজ

  1. অন্যত্র (পৃ ৩৫-৩৬) সম, অসম ও বিষম মাত্রার ছন্দের কথা বলা হয়েছে। সেখানে সমমাত্রার ছন্দ মানে জোড়মাত্রার ছন্দ। এখানে সে অর্থ নয়। এখানে সমমাত্রক ছন্দ মানে সমতল অর্থাৎ ধ্বনির হ্রস্বদীর্ঘতা বা উচ্চনীচতা-হীন ছন্দ। পরবর্তী ‘সমমাত্র হৃস্বস্বর’ লক্ষিতব্য। ৩ পৃষ্ঠাতেও এই অর্থে ‘সমমাত্রিক ছন্দ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে।
  2. দ্রষ্টব্য ২-৩ পৃষ্ঠা।
  3. তুলনীয়: কবিতা পড়িতে হইলে আমরা সুর করিয়া পড়ি পৃ ৪।