পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২০
ছন্দ

আমার ছন্দের গতি

 মনে হয় কবিতা যখন ছাপা হত না তখনই তার স্বরূপ উজ্জ্বল ছিল; কারণ কণ্ঠে আবৃত্তিতেই ছন্দের বিশেষত্ব ভালো করে প্রকাশ পায়। ছাপায় আমরা চোখ দিয়ে কবিতাকে দেখি, তার পংক্তি, গঠন লক্ষ্য করি। মনে মনে ধ্বনি উচ্চারণ করে কবিতাকে সম্ভোগ করতে আমরা আজকাল শিখেছি। কিন্তু কবিতা নিঃশব্দে পড়বার বস্তু নয়, কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়েই তার রূপ ভালো করে প্রকাশ পায়, স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাল্যকালের সেই ইচ্ছাই ছিল স্বাভাবিক— শোনালেই কবিতার সম্পূর্ণ রস পাওয়া যায়, নইলে অভাব ঘটে।...

 অল্পবয়সে প্রথমটা কিছুকাল অন্যের অনুকরণ অবশ্য করেছি। আমাদের বাড়িতে যে কবিদের সমাদর ছিল মনে করতুম তাঁদের মতো কবিতা লিখতে পারলে ধন্য হব। তাই তখনকার প্রচলিত ছন্দ অনুকরণের চেষ্টা অল্পকাল কিছু করেছি। অকস্মাৎ একসময় খাপছাড়া হয়ে কেমন ভাবে নিজের ছন্দে পৌঁছলাম। শুধু এইটুকু মনে আছে, একদিন তেতলার ছাদে স্লেট হাতে, মনটা বিষণ্ণ— কাগজে পেনসিলে নয়, স্লেটে লিখতে, অভ্যাসের পরিবর্তনেই হয়তো ছন্দের একটা পরিবর্তন এল যেটা তৎকালপ্রচলিত নয়, আমি বুঝতে পারলুম এটা আমার নিজস্ব। তারই প্রবল আনন্দে সেই নূতন ধারাতে চললাম। ভয় করিনি।[১] ...

 আমার কাব্যজীবনে দেখছি ক্রমাগত এক পথ থেকে অন্য পথে চলবার প্রবণতা, নদী যেমন করে বাঁক ফেরে। এক-একটা ছন্দ বা ভাবের পর্ব যখন শেষ হয়ে এসেছে বোধ হয় তখন নূতন ছন্দ বা ভাব মনে না এলে আর লিখিইনে।...

 ‘মানসী’তে আবার নূতন ভাঙন লেগেছিল, অন্যপথে চলেছিলাম, ছন্দেরও কতকগুলি বিশেষ ভঙ্গি চেষ্টা করেছিলাম। একথা মনে রাখতে

  1. দ্রষ্টব্য ‘সন্ধ্যাসংগীতএর ছন্দ’ পৃ ১৭৯।