পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বিশ্বভারতী.pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খোলা ছাতা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যেমনতরো হয়। গোফুর আলো নিয়ে বেরোল, প্রসন্ন বেরোল,বোটের মাঝিগুলো বেরোল, সবাই ভাগ ক’রে ভিন্ন ভিন্ন দিকে চললুম— আমি এক দিকে বিলু বলু ক’রে চীৎকার করছি— প্রসন্ন আর-এক দিকে ডাক দিচ্ছে 'ছোটো ম৷”— মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মাঝিরা বাবু ‘বাবু ক’রে ফুকরে উঠছে। সেই মরুভূমির মধ্যে নিস্তব্ধ রাত্রে অনেকগুলো আর্তস্বর উঠতে লাগল। কারও সাড়াশব্দ নেই। গোফুর দুই-একবার অতি দূর থেকে হেঁকে বললে দেখতে পেয়েছি, তার পরেই আবার সংশোধন ক’রে বললে ‘না না । আমার মানসিক অবস্থাটা একবার কল্পনা ক’রে দেখো— কল্পনা করতে গেলে নিঃশব্দ রাত্রি, ক্ষীণ চন্দ্রীলোক, নির্জন নিস্তব্ধ শূন্য চর, দূরে গোফুরের চলনশীল একটি লন্ঠনের আলো, মাঝে মাঝে এক-এক দিক থেকে কাতর কণ্ঠের আহবান এবং চতুর্দিকে তার উদাস প্রতিধ্বনি, মাঝে মাঝে আশার উন্মেষ এবং পরমুহুর্তেই সুগভীর নৈরাশ্ব, এই সমস্তটা মনে আনতে হবে। অসম্ভব রকমের আশঙ্কাসকল মনে জাগতে লাগল। কখনো মনে হল চোরাবালিতে পড়েছে, কখনো মনে হল বলুর হয়তে হঠাৎ মূৰ্ছা কিম্বা কিছু-একটা হয়েছে— কখনো বা নানাবিধ শ্বাপদ জন্তুর বিভীষিকা কল্পনায় উদয় হতে লাগল। মনে মনে হতে লাগল “আত্মরক্ষা-অসমর্থ যারা নিশ্চিন্তে ঘটায় তারা পরের বিপদ’। স্ত্রীস্বাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলুম। এমন সময়ে ঘণ্টাখানেক পরে রব উঠল এরা চড়া বেয়ে বেয়ে ও পারে গিয়ে পড়েছেন,আর ফিরতে পারছেন না। বোট ওপারে গেল ; বোটলক্ষ্মী বোটে ফিরলেন ; বলু বলতে লাগল, তোমাদের নিয়ে আমি আর কখনো বেরব না। সকলেই অনুতপ্ত, শ্রান্তকাতর, সুতরাং আমার ভালো ভালো উপাদেয় ভৎসনাবাক্য হৃদয়েই রয়ে গেল। পরদিন প্রাতঃকালে উঠেও কোনোমতেই রাগতে পারলুম না। W28