পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বিশ্বভারতী.pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

একটু নিস্তব্ধত,একটু খোলা আকাশ,সেইখানেই তার বিশাল হৃদয়ের অন্তর্নিহিত বৈরাগ্য এবং বিষাদ ফুটে ওঠে, সেইখানেই তার গভীর দীর্ঘনিশ্বাস শোনা যায়। ভারতবর্ষে যেমন বাধাহীন পরিষ্কার আকাশ, বহুদূরবিস্তৃত সমতলভূমি আছে, এমন যুরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এইজন্যে আমাদের জাতি যেন বৃহৎ পৃথিবীর সেই অসীম বৈরাগ্য আবিষ্কার করতে পেরেছে; এইজন্তে আমাদের পুরবীতে কিম্বা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের অস্তরের হা-হা-ধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারও ঘরের কথা নয়। পৃথিবীর একটা অংশ আছে যেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ ; তার ভাবটা আমাদের মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায় নি। পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জন, বিরল, অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। তাই সেতারে যখন ভৈরবীর মিড় টানে আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে। কাল সন্ধের সময় নির্জন মাঠের মধ্যে পুরবী বাজছিল, পাঁচ-ছ ক্রোশের মধ্যে কেবল আমি একটি প্রাণী বেড়াচ্ছিলুম, এবং আর-একটি প্রাণী বোটের কাছে পাগড়ি বেঁধে লাঠি হাতে অত্যন্ত সংযত ভাবে দাড়িয়ে ছিল। আমার বঁ। পাশে ছোটো নদীটি দুই ধারের উচু পাড়ের মধ্যেএকেবেঁকে খুব অল্প দূরেই দৃষ্টিপথের বার হয়ে গেছে ; জলে ঢেউয়ের রেখামাত্র ছিল না,কেবল সন্ধ্যার আভা অত্যন্ত মুমূর্ষ হাসির মতো খানিক ক্ষণের জন্যে লেগেছিল। যেমন প্রকাণ্ড মাঠ তেমনি প্রকাণ্ড নিস্তব্ধতা; কেবল একরকম পাখি আছে তারা মাটিতে বাস ক’রে থাকে, সেই পাখি যত অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল তত আমাকে তার নিরালা বাসার কাছে ক্রমিক আনাগোনা করতে দেখে ব্যাকুল সন্দেহের স্বরে ট-ট করে ডাকতে লাগল। ক্রমে এখনকার কৃষ্ণপক্ষের চাদের আলো ঈষৎ ফুটে উঠল। বরাবর নদীর ধারে ধারে মাঠের প্রান্ত দিয়ে একটা সংকীর্ণ পদচিহ্ন চলে গেছে, সেইখানে নতশিরে চলতে চলতে ভাবছিলুম। 8 (t