পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বিশ্বভারতী.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জল মাথায় মাথায় সমান, একটুও পাড় নেই। ক্রমে নদীর সেই ছিপছিপে আকারটুকু আর থাকে না, নানা দিকে নানা রকমে ভাগ হয়ে ক্রমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল। এই খানিকট সবুজ ঘাস, এই খানিকট স্বচ্ছ জল। দেখে পৃথিবীর শিশুকাল মনে পড়ে, অসীম জলরাশির মধ্যে যখন স্থল সবে একটুখানি মাথা তুলেছে, জলস্থলের অধিকার নির্দিষ্ট হয়ে যায় নি। চারিদিকে জেলেদের বঁাশ পোতা, জেলেদের জাল থেকে মাছ ছে মেরে নেবার জন্তে চিল উড়ছে, পাকের উপরে নিরীহ বক দাড়িয়ে আছে, নানা রকমের জলচর পাখি, জলে শু্যাওলা ভাসছে, মাঝে মাঝে পাকের মধ্যে অযত্বসস্তৃত ধানের গাছ, স্থির জলের উপর ঝাকে বাকে মশা উড়ছে। ভোরের বেলা বোট ছেড়ে দিয়ে কাচিকাঠায় গিয়ে পড়া গেল। একটি বারো-তেরো হাত সংকীর্ণ খালের মতে ক্রমাগত একে বেঁকে গেছে, সমস্ত বিলের জল তারই ভিতর দিয়ে প্রবল বেগে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে ; এর মধ্যে আমাদের এই প্রকাণ্ড বোট নিয়ে বিষম কাও— জলের স্রোত বিহ্যতের মতো বোটটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, দাড়ির লগি হাতে ক’রে সামলাবার চেষ্টা করছে পাছে ডাঙার উপরে বোটটাকে আছড়ে ফেলে। এ দিকে হু হু ক’রে বাদলার বাতাস দিচ্ছে, ঘন মেঘ করে রয়েছে, মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে, শীতে সবাই কঁপিছে। ক্রমে খোলা নদীতে এসে পড়লুম। শীতকালে মেঘাচ্ছন্ন ভিজে দিন ভারি বিশ্রী লাগে। সকাল বেলাটা তাই নিতান্ত নিজীবের মতো ছিলুম। বেলা দুটোর সময় রোদ উঠল। তার পর থেকে চমৎকার। খুব উচু পাড়ে বরাবর দুই ধারে গাছপালা লোকালয় এমন শান্তিময়, এমন সুন্দর, এমন নিভৃত— দুই ধারে স্নেহসৌন্দর্য বিতরণ করে নদীটি বেঁকে বেঁকে চলে গেছে, আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরচারিণী 6: 8