পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বিশ্বভারতী.pdf/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভাব কেন লেগে আছে। তার কারণ এই মনে হল, আমাদের দেশে প্রকৃতিটা সব চেয়ে বেশি চোখে পড়ে— আকাশ মেঘমুক্ত, মাঠের সীমা নেই, রৌদ্র বাবা করছে— এর মধ্যে মানুষকে অতি সামান্ত মনে হয় ; মানুষ আসছে এবং যাচ্ছে, এই খেয়ানেীকোর মতো পারাপার হচ্ছে, তাদের অল্প অল্প কলরব শোনা যায়, এই সংসারের হাটে ছোটোখাটো সুখদুঃখের চেষ্টায় একটুখানি আনাগোনা দেখা যায় ; কিন্তু এই অনন্তপ্রসারিত প্রকাণ্ড উদাসীন প্রকৃতির মধ্যে সেই মৃন্থগুঞ্জন, সেই একটু-আধটু গীতধ্বনি, সেই নিশিদিন কাজকর্ম কী সামান্ত, কী ক্ষণস্থায়ী, কী নিস্ফলকাতরতাপূর্ণ মনে হয়। এই নিশ্চেষ্ট নিস্তব্ধ নিশ্চিন্ত নিরুদ্দেশ প্রকৃতির মধ্যে এমন একটি বৃহৎ সৌন্দর্যপূর্ণ নির্বিকার উদার শান্তি দেখতে পাওয়া যায় এবং তারই তুলনায় আপনার মধ্যে এমন একটা সততসচেষ্ট পীড়িত জর্জরিত ক্ষুদ্র নিত্যনৈমিত্তিক অশাস্তি দেখতে পাওয়া যায় যে, ঐ অতিদূর নদীতীরের ছায়াময় নীল বনরেখার দিকে চেয়ে নিতান্ত উন্মনা হয়ে যেতে হয়। ‘ছায়াতে বসিয়া সারা দিনমান তরুমর্মর পবনে’ ইত্যাদি । যেখানে মেঘে কুয়াশায় বরফে অন্ধকারে প্রকৃতি আচ্ছন্ন, সংকুচিত, সেখানে মানুষের খুব কর্তৃত্ব— মানুষ সেখানে আপনার সকল ইচ্ছা সকল চেষ্টাকে চিরস্থায়ী মনে করে, আপনার সকল কাজকে চিহ্নিত করে রেখে দেয়, পস্টারিটির দিকে তাকায়, কীর্তিস্তম্ভ তৈরি করে, জীবনচরিত লেখে, এবং মৃতদেহের উপরেও পাষাণের চিরস্মরণগৃহ নির্মাণ করে ; তার পরে অনেক চিহ্ন ভেঙে যায় এবং অনেক নাম বিস্মৃত হয়, কিন্তু সময়াভাবে সেটা কারও খেয়ালে আসে না ।