পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বিশ্বভারতী.pdf/৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বন্দোরা সমুদ্রতীর

৩০ অক্টোবর ১৮৮৫

 ভারি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ক্রমাগতই বৃষ্টি। এখনো বিরামের লক্ষণ নেই। আমার বারান্দার কাঁচের জানালা সমস্ত বন্ধ ক'রে চুপ মেরে বসে আছি। নিতান্ত মন্দ লাগছে না, আপনাতে আপনি বেশ একরকম আচ্ছন্ন হয়ে আছি—কোনোপ্রকার emotionএর প্রাবল্য নেই—ঝড়-ঝঞ্ঝা যা কিছু সমস্তই বাহিরে। অসহায় অনাবৃত সমুদ্র ফুলে ফুলে ফেনিয়ে ফেনিয়ে শাদা হয়ে উঠছে। সমুদ্রকে দেখে আমার মনে হয় কী একটা প্রকাণ্ড অন্ধ শক্তি বাঁধা প'ড়ে আস্ফালন করছে—আমরা নিশ্চিন্তমনে তীরে দাঁড়িয়ে আছি—সমুদ্রের বিস্ফারিত গ্রাসের মুখেই আমরা ঘরবাড়ি বেঁধে বসে আছি। আমরা যেন সিংহের কেশর ধরে টানছি, অথচ অসহায় সিংহ কিছু বলতে পারছে না—একবার যদি সমস্ত সমুদ্র ছাড়া পায় তা হলে আমাদের আর চিহ্নমাত্র থাকে না। খাঁচার মধ্যে বাঘ তার লেজ আছড়াচ্ছে, আমরা কেবল দু হাত তফাতে দাঁড়িয়ে হাসছি। একবার চেয়ে দেখুন কি বিপুল বল। তরঙ্গগুলো যেন দৈত্যের মাংসপেশীর মতো ফুলে উঠছে। পৃথিবীর সৃষ্টির আরম্ভ থেকে এই ডাঙায় জলে লড়াই চলছে—ডাঙা ধীরে ধীরে নীরবে এক-এক পা ক'রে আপনার অধিকার বিস্তার করছে, আপনার সন্তানদের ক্রমেই কোল বাড়িয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে—আর পরাজিত সমূদ্র পিছু হটে হটে কেবল ফুঁসে ফুঁসে বক্ষে করাঘাত করে মরছে। মনে রাখবেন এক কালে সমুদ্রের একাধিপত্য ছিল—তখন সে সম্পূর্ণ মুক্ত। ভূমি তারই গর্ভ থেকে উঠে তার সিংহাসন কেড়ে নিয়েছে, উন্মাদ বৃদ্ধ সমুদ্র তার শুভ্র ফেনা নিয়ে King Lear'এর মতো ঝড়ে ঝঞ্ঝায় অনাবৃত আকাশে কেবল বিলাপ করছে।