পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( > - ) বিধতে লাগল—মনে হল বাতাস পিছন থেকে ঘাড় ধরে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্চে— ফোটা ফোটা বৃষ্টিও পিটু পিটু করে মুখের উপর সবেগে আঘাত করতে লাগল। দৌড়, দৌড়। মাঠ সমান নয়। এক এক জায়গায় আবার খোয়াইয়ের ভিতর নাবৃতে হয়, সেখানে সহজ অবস্থাতেই চলা শক্ত, এই ঝড়ের বেগে চলা আরো মুস্কিল। পথের মধ্যে আবার পায়ে কাটামুদ্ধ একটা শুকনো ডাল বিধে গেল—সেটা ছাড়াতে গিয়ে বাতাস আবার পিছন থেকে ঠেলা দিয়ে মুখ থুবড়ে ফেলবার চেষ্টা করে । বাড়ির যখন প্রায় কাছাকাছি এসেচি, তখন দেখি, তিন চারটে চাকর মহা সোরগোল করে দ্বিতীয় আর একটা ঝড়ের মত আমাদের উপরে এসে পড়ল । কেউ হাত ধরে, কেউ আহ উহু বলে, কেউ পথদেখাতে চায়, কেউ আবার মনে করে বাবু বাতাসে উড়ে যাবেন বলে’ পিঠের দিক থেকে জড়িয়ে ধরে ; এই সমস্ত অনুচরদের দৌরাত্ম্য কাটিয়ে কুটিরে এলোমেলো চুলে, ধুলিমলিন দেহে, সিক্ত বস্ত্রে, হঁাপিয়ে বাড়িতে এসেত পড়লুম। যাহোক, একটা খুব শিক্ষালাভ করেছি—হয়ত কোনদিন কোন কাব্যে কিম্বা উপন্যাসে বর্ণনা করতে বস্তু একজন নায়ক মাঠের মধ্যে দিয়ে ভীষণ ঝড়বৃষ্টি ভেঙে নায়িকার মধুর মুখচ্ছবি স্মরণ ক’রে অকাতরে চলে যাচ্চে–কিন্তু এখন আর এরকম মিথ্যে কথা লিখতে পারব না ; ঝড়ের সময় করে। মধুর মুখ মনে রাখা অসম্ভব—কি করলে চোখে কাকর ঢুকবেন। সেই চিন্তাই সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে । আমার আবার চোখে eye-glass ছিল, সেটা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে ফেলে, কিছুতেই রাখতে পারিনে । এক হাতে চষমা ধরে আর এক হাতে ধুতির কোচ সাম্লে পথের কাটাগাছ এবং গৰ্ত্ত বাচিয়ে চলচি। যদি এখানকার কোপাই নদীর ধারে আমার কোন প্রণয়িনীর বাড়ি থাকত, আমার চষমা এবং কোচ সাম্লাতুম, ন, তার স্মৃতি সামলাতুম ! বাড়িতে ফিরে এসে কাল অনেকক্ষণ ভাবলুম—বৈষ্ণব কবির গভীর রাত্রে ঝড়ের সময় রাধিকার অকাতর অভিসারসম্বন্ধে অনেক ভাল ভাল মিষ্টি কবিতা লিখেচেন—কিন্তু একটা কথা ভাবেননি এরকম ঝড়ে কৃষ্ণের কাছে তিনি কি মূৰ্ত্তি নিয়ে উপস্থিত হতেন ? চুলগুলোর অবস্থা যে কিরকম হত সেত বেশ বোঝা যাচ্চে । বেশবিন্যাসেরই বা কিরকম দশা ! ধূলাতে লিপ্ত হয়ে, তার উপর বৃষ্টির জলে কাদা জমিয়ে কুঞ্জবনে কিরকম অপরূপ মূৰ্ত্তি করে গিয়েই দাড়াতেন ! এসব কথা কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের লেখা পড়বার সময় মলে হয় না—কেবল সানসচক্ষে ছবির মত দেখতে পাওয়া যায় একজন সুন্দরী শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রে বিকশিত কদম্ববনের ছায়া দিয়ে যমুনার তীরপথে প্রেমের আকর্ষণে