পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিলাইদহ ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৪ । অদৃষ্ট্রের পরিহাসবশতঃ, ফাস্তনের এক মধ্যান্ত্রে এই নির্জন অবসরে এই নিস্তরঙ্গ পদ্মার উপরে এই নিভূত নৌকার মধ্যে বসে, সমুথে সোনার রৌদ্র এবং সুনীল আকাশ নিয়ে আমাকে একথান বই সমালোচনায় প্রবৃত্ত হতে হচ্চে । সে বইও কেউ পড়বে ন। সে সমালোচনাও কেউ মনে রাখবে না মাঝের থেকে এমন দিনটা মাটি করতে হবে । জীবনে এমন দিন কটাই বা আসে ! অধিকাংশ দিনই ভাঙাচোরা জোড়াতাড়া ; আজকের দিনটি যেন নদীর উপরে সোনার পদ্মফুলের মত ফুটে উঠেচে, আমার মনটিকে তার মৰ্ম্মকোষের মধ্যে টেনে নিচে । আবার হয়েচে কি, একটা হলদেকোমরবন্ধ পরা স্নিগ্ধ বেগনিরঙের মস্ত ভ্রমর আমার বোটের চারদিকে গুঞ্জনসহকারে চঞ্চল হয়ে বেড়াচ্চে । বসন্তকালে ভ্রমরগুঞ্জনে বিরহিণীর বিরহ বেদন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এ কথাটাকে আমি বরাবর পরিহাস করে এসেছি, কিন্তু ভ্রমর গুঞ্জনের মৰ্ম্মটা আমি একদিন পরবেল বোলপুরে প্রথম আবিষ্কার করেছিলুম । সেদিন নিষ্কৰ্ম্মার মত দক্ষিণের বারান্দায় বেড়াচ্ছিলুম—মধ্যাহ্নটা মাঠের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল, গাছের নিবিড় পল্লবগুলির মধ্যে স্তব্ধত যেন রাশীকৃত হয়ে উঠেছিল । সেই সময়টায় বারান্দার নিকটবৰ্ত্তী একটা মুকুলিত নিমগাছের কাছে ভ্রমরের অলসগুঞ্জন সমস্ত উদাস মধ্যাহ্নের একটা সুর বেঁধে দিচ্ছিল । সেইদিন বেশ বোঝা গেল মধ্যাহ্নের সমস্ত পাঁচমিশালি শ্রাস্তমুরের মূল স্বরটা হচ্চে ঐ ভ্রমরের গুঞ্জন—তাতে বিরহিণীর মনটা যে হঠাৎ হাঁহ করে উঠবে তাতে আশ্চৰ্য্য কিছুই নেই। আসল কথাটা হচ্চে, ঘরের মধ্যে যদি থামখা একটা ভ্রমর এসে পড়েই ভোভে করতে সুরু করে এবং ক্ষণে ক্ষণে শাসির কাচে মাথ। ঠুকতে থাকে তবে তাতে করে তার নিজের ছাড়া আর কারো কোনো প্রকার ব্যথা লাগ্ৰবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ঠিক জায়গাটিতে সে ঠিক স্বরই দেয় । আজকের আমার এই সোনার মেখলাপরা ভ্রমরটিও ঠিক মুরটি লাগিয়েছে । নিশ্চয়ই বোধ হচ্চে কোনো গ্রন্থের সমালোচনা করচে না—কিন্তু কেন যে আমার নৌকার চারপাশে ঘুর ঘুর করে মরচে আমি ত বুঝতে পারচিনে—নিরপেক্ষ বিচারকমাত্রইত বলবে আমি শকুন্তল বা সে জাতীয় কেউ নই ৷