পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কলিকাতা

জুন, ১৮৮৯

 গাড়ি ছাড়বার পর বে—চারিদিক চেয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল, ভাবলে এসংসারে কোথা থেকে আগমন, কোথায় গতি, জীবনের উদ্দেশ্য কি—ভাবতে ভাবতে ক্রমে দেখ্‌লুন ঘন ঘন হাই তুলতে লাগ্‌ল, তার পরে খানিক বাদে আমার কোলে মাথা রেখে পা ছড়িয়ে নিদ্রা আরম্ভ করে দিল। আমার মনেও সংসারের সুখদুঃখসম্বন্ধে নানাবিধ চিন্তার উদয় হয়েছিল, কিন্তু ঘুম এল না। সুতরাং আপন মনে ভৈরবী আলাপ করতে লাগলুম। ভৈরবী সুরের মোচড়গুলো কানে এলে জগতের প্রতি এক রকম বিচিত্র ভাবের উদয় হয়। মনে হয় একটা নিয়মের যন্ত্র-হস্ত অবিশ্রাম আর্গিন যন্ত্রের হাতা ঘোরাচ্চে এবং সেই ঘর্ষণ বেদনার সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মর্ম্মস্থল হতে একটা গম্ভীর কাতর করুণ রাগিণী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠচে। সকালবেলাকার সূর্য্যের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে এসেচে, গাছপালা নিস্তব্ধ হয়ে কি যেন শুনচে, এবং আকাশ একটা বিশ্বব্যাপী অশ্রুর বাষ্পে যেন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে অর্থাৎ দূর আকাশের দিকে চাইলে মনে হয় যেন একটা অনিমেষ নীল চোখ কেবল ছলছল করে চেয়ে আছে।

 খিড়কি ষ্টেসনের কাছাকাছি আমাদের সেই আকের ক্ষেত, গাছের সার, টেনিস ক্ষেত্র, কাঁচের জানালা-মোড়া বাড়ি দেখতে পেলুম, দেখে মনটা ক্ষণকালের জন্য কেমন করে উঠল। এই এক আশ্চর্য্য! যখন এখানে বাস করতুম তখন এ বাড়ির উপরে যে সবিশেষ স্নেহ ছিল তা নয়—যখন এবাড়ি ছেড়ে। গিয়েছিলুম তখনও যে সবিশেষ কাতর হয়েছিলুম তাও বলতে পারিনে অথচ দ্রুতগতি ট্রেনের বাতায়নে বসে যখন কেবল নিমেষের মত দেখলুম সেই একলা বাড়ি তার থেলার জায়গা এবং ফাঁকা ঘরগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন সমস্ত হৃদয়টা বিদ্যুৎবেগে সেই বাড়ির উপরে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়ল, অমনি বুকের ভিতরে বাঁদিক থেকে ডান দিক পর্য্যন্ত ধক্‌করে একটা শব্দ হল, হুস্‌ করে গাড়ি চলে গেল, আকের ক্ষেত মিলিয়ে গেল—বাস্‌ সমস্ত ফুরোল—কেবল হঠাৎ ঘা খাওয়ার দরুণ মনের ছোট বড় দু চারটে তার প্রায় দেড় সুর