পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

( ৬৬ )

লাভকরে। তাদের উপরে যেন বহুকালের একটা সম্পদশ্রীর আভা থাকে। একজন সোনার ব্যাপারী হঠাৎ বড়মানুষ হয়ে উঠ্‌লে অনেক সোনা পায় কিন্তু সেই সোনার লাবণ্যটুকু শীঘ্র পায় না। যাহোক্ আর একশো বৎসর পরে যখন এই তীরের গাছগুলো আরো অনেক বড় হয়েউঠ্‌বে, তক্‌তকে শাদা মাইলষ্টোন্‌গুলো অনেকটা ক্ষয়ে গিয়ে শৈবালাচ্ছন্ন ম্লান হয়েআসবে, লকের উপরে খোদিত 1871 তারিখ যখন অনেক দূরবর্ত্তী বলে মনে হবে তখন যদি আমি আমার প্রপৌত্র জন্মলাভকরে এই খালের মধ্যে বোট নিয়ে আমাদের পাণ্ডুয়া জমিদারী-তদন্ত করতে যেতেপারি তখন আমার মনের মধ্যে অনেকটা ভিন্নরকম ভাবোদয় হতেপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু হায় আমার প্রপৌত্র! তার ভাগ্যে কি আছে কে জানে! হয়ত একটা অজ্ঞাত অখ্যাত কেরানিগিরি। ঠাকুরবংশের একটা ছিন্ন টুক্‌রো, বহুদুরে প্রক্ষিপ্ত হয়ে একটা মৃত উল্কাখণ্ডের মত হয়ত জ্যোতিহীন নির্ব্বাপিত। কিন্তু আমার উপস্থিত দুর্দ্দশা এত আছে যে আমার প্রপৌত্রের জন্যে বিলাপকরবার কোন দরকার নেই।

 চারটের সময় তারপুরে পৌঁছনগেল। এইখানে আমাদের পাল্কীযাত্রা আরম্ভ হল। মনে করলুম দুক্রোশ পথ, সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই আমাদের কুঠিতে পৌঁছতে পারব। মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম, মাইলের পর মাইল কেটেযাচ্চে, ছ ক্রোশ পথ আর ফুরোয় না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় বেহারাদের জিজ্ঞাসাকরলুম আর কতদূর, তারা বল্লে, আর বেশি নেই, তিন ক্রোশের কিছু উপর বাকি আছে। শুনে পাল্কীর মধ্যে একটু নড়েচড়ে বস্‌লুম। পাল্কীতে আমার আধখানা বই ধরে না— কোমর টন্ টন্ করচে, পা ঝিন্ ঝিন্ করচে, মাথা ঠক্ ঠক্ করচে—যদি নিজেকে তিন চার ভাঁজকরে মুড়েরাখবার কোন উপায় থাক্‌ত তা হলেই এই পাল্কীতে কিছু সুবিধে হতেপারত। রাস্তা অতি ভয়ানক। সর্ব্বত্রই এক হাঁটু কাদা—একএক জায়গায় পিছলের ভয়ে বেহারারা অতি সাবধানে একএক পা করে পা ফেল্‌চে—তিনচারবার তাদের পা হড়্‌কে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি সামলেনিলে। মাঝে মাঝে রাস্তা নেই—ধানের ক্ষেতে অনেকখানি করে জল দাঁড়িয়েছে—তারি উপরদিয়ে ছপ্ ছপ্ শব্দকরে এগোচ্চি। মেঘে রাত খুব অন্ধকার হয়েএসেচে, টিপ্‌টিপ্‌করে বৃষ্টি পড়চে, তৈলাভাবে মশালটা মাঝেমাঝে নিবেযাচ্চে, আবার অনেক ফুঁ দিয়েদিয়ে জ্বালাতেহচ্চে, বেহারারা সেই আলোকের অভাব নিয়ে ভারি বকাবকি বাধিয়েদিয়েচে। এমনি করে খানিকদূরে এলে পর বরকন্দাজ যোড়হাতে নিবেদনকরলে, একটা নদী এসেছে