পাতা:ছেলেবেলা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চাটুজ্জে। সমস্ত রামায়ণের পাঁচালি ছিল সুর-সমেত তার মুখস্থ। সে হঠাৎ আসন দখল করে কৃত্তিবাসকে ছাপিয়ে দিয়ে হু হু করে আউড়িয়ে যেত তার পাঁচালির পালা— ‘ওরে রে লক্ষ্মণ, এ কী অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ।’ তার মুখে হাসি, মাথায় টাক ঝক্‌ ঝক্ করছে, গলা দিয়ে ছড়াকাটা লাইনের ঝর্‌না সুর বাজিয়ে চলছে, পদে পদে শব্দের মিলগুলো বেজে ওঠে যেন জলের নিচেকার নুড়ির আওয়াজ। সেই সঙ্গে চলত তার হাত পা নেড়ে ভাব-বাৎলানো।

 কিশোরী চাটুজ্জের সব চেয়ে বড়ো আপশোস ছিল এই যে দাদাভাই, অর্থাৎ কি না আমি, এমন গলা নিয়ে পাঁচালির দলে ভর্তি হতে পারলুম না। পারলে দেশে যা-হয় একটা নাম থাকত।

 রাত হয়ে আসত, মাদুর-পাতা বৈঠক যেত ভেঙে। ভূতের ভয় শিরদাঁড়ার উপর চাপিয়ে চলে যেতুম বাড়ির ভিতরে মায়ের ঘরে। মা তখন তাঁর খুড়িকে নিয়ে তাস খেলছেন। পংখের- কাজ-করা ঘর হাতির দাঁতের মতো চক চকে, মস্ত তক্তপোষের উপর জাজিম পাতা। এমন উৎপাত বাধিয়ে দিতুম যে, তিনি হাতের খেলা ফেলে দিয়ে বলতেন, ‘জ্বালাতন করলে! যাও খুড়ি, ওদের গল্প শোনাও গে।’ আমরা বাইরের বারান্দায় ঘটির জলে পা ধুয়ে দিদিমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় উঠতুম। সেখানে শুরু হ’ত দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে আনার পালা। মাঝখানে আমারই ঘুম ভাঙায় কে। রাতের প্রথম পহরে শেয়াল উঠত ডেকে। তখনো শেয়াল-ডাকা রাত কলকাতার কোনো কোনো পুরোনো বাড়ির ভিতের নীচে ফুকরে উঠত।

২২