পাতা:ছেলেবেলা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

8

আমরা যখন ছোটো ছিলুম তখন সন্ধ্যাবেলায় কলকাতা শহর এখনকার মতো এত বেশি সজাগ ছিল না। এখনকার কালে সূর্যের আলোর দিনটা যেমনি ফুরিয়েছে অমনি শুরু হয়েছে বিজলি আলোর দিন। সে সময়টাতে শহরে কাজ কম, কিন্তু বিশ্রাম নেই। উনুনে যেন জ্বলা কাঠ নিভেছে, তবু কয়লায় রয়েছে আগুন।— তেলকল চলে না, স্টিমারের বাঁশি থেমে থাকে, কারখানা-ঘর থেকে মজুরের দল বেরিয়ে গেছে, পাটের-গাঁট-টানা গাড়ির মোষগুলো গেছে টিনের চালের নীচে শহুরে গোষ্ঠে। সমস্তদিন যে শহরের মাথা ছিল নানা চিন্তায় তেতে আগুন, এখনো তার নাড়ীগুলো যেন দব্ দব্ করছে। রাস্তার দু ধারে দোকানগুলোতে কেনাবেচা তেমনি আছে, কেবল সামান্য কিছু ছাই-চাপা। রকম-বেরকমের গোঙানি দিতে দিতে হাওয়াগাড়ি ছুটেছে দশ দিকে, তাদের দৌড়ের পিছনে গরজের ঠেলা কম।

 আমাদের সেকালে দিন ফুরোলে কাজকর্মের বাড়তি ভাগ যেন কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ত শহরের বাতি-নেবানো নীচের তলায়। ঘরে বাইরে সন্ধ্যার আকাশ থম্ থম্ করত। ইডেন গার্ডেনে গঙ্গার ধারে শৌখিনদের হাওয়া খাইয়ে নিয়ে ফেরবার গাড়িতে সইসদের হৈ হৈ শব্দ রাস্তা থেকে শোনা যেত। চৈৎ-বৈশাখ মাসে রাস্তায় ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত ‘বরীফ’। হাঁড়িতে বরফ দেওয়া নোনতা জলে ছোটো ছোটো টিনের চোঙে থাকত যাকে বলা হ’ত কুলফির বরফ, এখন যাকে বলে আইস কিংবা আইস্‌ক্রিম। রাস্তার দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ডাকে মন কিরকম করত তা মনই জানে। আর-একটা হাঁক ছিল ‘বেলফুল’।

২৩