পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

মধ্যে? আশ্বিনের প্রভাতটি ছিল উজ্জ্বল। দুদিন দুরাত্রির মরণাধিক যন্ত্রণা শ্যামা দুঃস্বপ্নের মত ভুলিয়া গিয়াছিল। আজ সকালে তাহার আনন্দের সীমা নাই।

 তখন ঘটিয়াছিল এক কাণ্ড।

 ঘুম ভাঙ্গিয়া হঠাৎ শিশু যেন কি-রকম করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। টানিয়া টানিয়া শ্বাস নেয়, চঞ্চলভাবে হাত পা নাড়ে, চোখ কপালে তুলিয়া দেয়। ভযে শ্যামা বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল। ডাকিয়াছিল, ঠাকুরঝি গাে, ও ঠাকুরঝি।

 রান্না ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া মন্দা হইয়াছিল রাগিয়া আগুন।

 চোখ নেই বৌ? সরো তুমি সরো। গলা শুকিয়ে এমন করছে গাে আহা। মধুর বাটি গেল কোথা? মিছরির জল? দিয়েছো তাে উল্টে? আশ্চর্যি!

 তাকের উপর শিশিতে মধু ছিল। ছােট একটি বাটিতে মধু ঢালিয়া আঙ্গুলে করিয়া ছেলের মুখ ভিজাইয়া চোখের পলকে মন্দা তাহাকে শান্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। বিড় বিড় করিয়া বলিয়াছিল, আনাড়ি বলে আনাড়ি, এমন আনাড়ি জন্মে চোখে দেখিনি মা! কচি ছেলে পলকে পলকে গলা শুকোবে তাও যদি না টের পাও তবে মা হওয়া কেন? দাইমাগীও মানুষ কেমন? তামাকপাতা আনতে গিয়ে বুড়ী হ'ল।

 এই তুচ্ছ ঘটনাটি শ্যামার মনে গাঁথা হইয়া আছে। প্রথম সন্তানকে সে যে বারোদিনের বেশি বাঁচাইতে পারে নাই তার সবটুকু অপবাধ চিরকাল শ্যামা নিজের বলিযা স্বীকার করিয়া লইয়াছে। সন্তান পবিচর্যার কিছুই সে যে তখন জানিত না এই ঘটনাটি শ্যামার কাছে হইয়া আছে তাহার আদিম প্রমাণের মত। তখন অবশ্য সে জানিত না বারোদিন পরে পেট ফুলিয়া ছেলে তাহার মরিয়া যাইবে। মন্দা চলিয়া গেলে ছেলের দিকে চোখ রাখিয়া সে শান্তভাবেই শুইয়া ছিল, গলা শুকানাের লক্ষণ দেখা গেলে মুখে মধু দিবে। অন্যমনে সে অনেক কথা ভাবিয়াছিল। দরজা দিয়া দুটি চড়াই পাখী ঘরে ঢুকিয়া খানিক এদিক ওদিক ফড়ফড় করিয়া উড়িয়া জানালা দিয়া বাহির