পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
জননী

কেবল শ্যামার নিদ্রাতুর আরক্ত চেখে জল আসে। এ ক’দিন শ্যামা যেন ছিল একটা কামনার রূপক, সন্তানকে সুস্থ করার একটি জলন্ত ইচ্ছা-শিখা—আজ তাহাকে চেনা যায় না। চোদ্দ দিনে বকুলের জ্বর ছাড়িয়াছে? কিসের চোদ্দ দিন—চোদ্দ যুগ।

 শ্রাবণের শেষে মামা একদিন দোকানটা বেচিয়া দিল। দোকান করা মামার পোষাইল না। ভদ্রলোক দোকান করিতে পারে? শ্যামা হাসিয়া বলিল, তখনি বলেছিলাম মামা, দিও না দোকান তুমি, কেন দোকান চালাতে পারবে?—কত টাকা লোকসান দিলে?

 মামা বলিল, লোকসান দেব আমি? কি যে তুই বলিস শ্যামা।

 তাহ’লে কত টাকা লাভ হ’ল তাই বল?

 না লাভ হয় নি, টায় টায় দেনা-পাওনায় মিল খেয়েছে, ব্যস্। যে দিনকাল পড়েছে শ্যামা, আমি বলে তাই, আর কেউ হ’লে ঘর থেকে টাকা ঢেলে খালি হাতে ফিরে আসত কত কোম্পানী এবার লালবাতি জ্বেলেছে জানিস?

 দোকান বেচিয়া মামা এবার করিবে কি? যে দুর্নিনেয় উৎস হইতে দরকার হইলেই দশ বিশটা টাকা উঠিয়া আসে, চিরকাল তাহা টিঁকিবে তো? মামা কিছু বলে না। করুণভাবে মামা শুধু একটু হাসে, উৎসুক চোখে আকাশের দিকে তাকায়। শরৎ মানুষকে ঘরের বাহির করে বর্ষান্তে নবযৌবনা ধরণীর সঙ্গে মানুষের পরিচয় কাম্য, কিন্তু বর্ষা তো এখনো শেষ হয় নাই। মামা, ওই দেখো আকাশে নিবিড় কালো সজল মেঘ শরৎ, কোথায় যে তুমি দেশে দেশে নিজের মনের মৃগয়ায় যাইতে চাও? মামার বিষণ্ণ হাসি, উৎসুক চোখ শ্যামাকে ব্যথা দেয়। শ্যামা ভাবে কিছু করিতে না পারিয়া হার মানার দুঃখে মামা ম্রিয়মাণ হইয়া গিয়াছে, ভাগ্নীর ভার লইবে বলিয়া অনেক আস্ফালন করিয়াছিল কিনা এখন তাহার লজ্জা অসিয়াছে। চোরের মত মামা তাই অস্বস্তিতে উসখুস করে। আহা, বুড়া মানষ সারাটা জীবন ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাটাইয়া আসিয়া সংসারের পাকা উপার্জনে অভ্যস্ত লোক গুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কেন পারিয়া উঠিবে? টাকা তো পথে ছড়ানো নাই। ঘরে ঘরে যুবক বেকার হাহাকার করিতেছে। ষাট বছরের ঘর-ছাড়া