পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১২৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জননী
১২১

অজু বলিয়া ডাকে, বিধানের সঙ্গে তাহার খুব ভাব হইয়া গেল। অজয় একক্লাশ নিচে পড়ে। পড়াশোনায় বিধান বড় ভাল, মন্দার ছেলেদের মাস্টার একদিন বিধানকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া এই রায় দিয়াছেন। মন্দা জানিয়া খুশি হইয়াছে। বিধান কলিকাতার ছেলে বলিয়া অজয়ের সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠতায় মন্দার যেটুকু ভয় ছিল মাস্টারের মন্তব্য শোনার পর আর তাহা নাই।

 সুপ্রভা বকুলকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে।

 বলে, কি মেয়ে আপনার বৌদিদি, দিয়ে দিন মেয়েটা আমাকে। দেবেন?

 বলে, মেয়ে বলে ওকে কিছু শেখাচ্ছেন না, এতো ভাল কথা নয়। আজকালকার দিনে লেখাপড়া গানটান না জানলে কে নেবে মেয়েকে? একটু একটু সবি শেখাতে হবে ঠাকুরঝি।

 সুপ্রভাই উদ্যোগ করিয়া বকুলকে মেয়েস্কুলে ভর্তি করিয়া দিল, বলিল স্কুলের মাহিনা সেই দিবে। গানটান শিখাইবার যখন উপায় নাই, লেখাপড়াই একটু শিখুক। বকুলকে সে যত্ন করে লুকাইয়া ভাল জিনিস খাইতে দেয়, যে সব জিনিস শুধু মন্দা ও তার ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু একা বকুল ওসব খাইতে চায় না, বলে, দাদাকে দাও, ভাইকে দাও? সুপ্রভা তাতে বড় খুশি হয়। কি নিস্বার্থপর মেয়েটার মন? যেমন দেখিতে সুন্দর তেমনি মিষ্টি স্বভাব। ও যেন রাজরাণী হয় ভগবান।

 রাজরাণী? এতবার সুপ্রভা এই আশীর্বাদের পুনবাবৃত্তি করে কেন, বকুলকে রাজরাণী করিতে এত তাহার উৎসাহ কিসের? রাজরাণী হওয়ার সখ ছিল নাকি সুপ্রভার, মনে সেই ক্ষোভ রহিয়া গিয়াছে? কিছু বুঝিবার উপায় নাই। সুপ্রভাকে অসুখী মনে হয় কদাচিৎ। চুপচাপ বসিয়া সে অনেক সময়ই থাকে। সেটা তার স্বভাব। মুখ তাহার সব সময় বিমর্ষ দেখায় না, চোখে তাহার সব সময় ঘনাইয়া আসে না উৎসুক দিবা-স্বপ্নাতুরার দৃষ্টি। তবু শ্যামা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে। অত যার রূপ সে কি একেবারেই নিজের মূল্য জানে না, কুমারী জীবনে আশা কি সে করে নাই, কল্পনা কি তার ছিল না? বুড়া বয়সে রাখাল যখন তাহাকে বিবাহ করিয়া তিন পুত্রের জননী সতীনের সংসারে আনিয়াছিল, গোপনে সে কি দু’এক বিন্দু অশ্রুপাত করে নাই?