পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৩৫

মাসে তাকে টাকা পাঠায়—এটা হারাণকে জানিতে দেওয়াই ভাল। পরে যদি হারাণ জানিতে পারে শ্যামা কলিকাতা আসিয়াছিল? তখন কি হইবে? হারাণ কি তখন মনে করিবে না যে সব জানিয়াও টাকার লোভে শ্যামা চুপ করিয়া আছে?

 হারান আসিলে শ্যামা তাহাকে প্রণাম করিল। বলিল, ভাল আছেন বাবা আপনি? কাল সন্ধেবেলা এসে পৌঁছেচি, আমি আগে তো জানতে পারি নি কবে খালাস পেয়ে এখানে এসে পড়ে রয়েছে—বিপদের ওপর কি যে আমার বিপদ আসছে বাবা, কোন দিকে কুল কিনারা দেখতে পাইনে। সমস্ত মুখ ফুলে গিয়েছে। শরীরে দারুণ জ্বর, ডাকলে ডুকলে সাড়াও ভাল করে দেয় না বাবা। শ্যামা চোখ মুছিতে লাগিল।

 হারান যেন অপরিবর্তনীয়। মাথার চুলে পাক ধরিবে, দেহে বার্ধক্য আসিবে তবু সে কণামাত্র বদলাইবে না। বিধানের প্রথম অসুখের সময় দেখিতে আসিয়া যেমন নির্মমভাবে শ্যামাকে সে কাঁদিতে বারণ করিয়াছিল, আজও তেমনি ভাবে বারণ করিল। শ্যামার জীবনে রহস্যময় দুর্বোধ্য মানুষের পদার্পণ আরও ঘটিয়াছে বৈকি। গোড়ায় ছিল রাখাল, তারপর আসিয়াছিল মামা তারাশঙ্কর। কিন্তু এই লোকটির সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না। একে একে তাদের রহস্যের আবরণ খসিয়া গিয়াছে, হারান শুধু চিরকাল যবনিকার আড়ালে রহিয়া গেল। শ্যামাকে যদি সে স্নেহ করে, স্নেহের পাত্রীকে দেখিয়া একবিন্দু খুসি কি তাহার হইতে নাই? আজও হারান ডাক্তার শুধু রোগী দেখিতে আসার মত শ্যামার বাড়ি আসিবে, আত্মীয় বলিয়া ধরা দিবে না?

 শীতলকে হারান অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিল।

 বাহিরে আসিয়া রাখাল ও শ্যামাকে বলিল, কদ্দিন জ্বরে ভুগছে জানিনে বাবু। আমি জিজ্ঞাসা করলে বলতে চায় না। অনেকদিন থেকে না খেয়ে শুকোচ্ছে সেটা বুঝতে পারি। তারপর লাগিয়েছে ঠাণ্ডা। সব জড়িয়ে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে সারতে সময় নেবে—বড় ডাক্তার ডাকতে চাও ডাকো, আমি বারণ করিনে, কিন্তু ডাক্তার ফাক্তার ডাকা মিছে। তাও বলে বাখছি—ওর সব চেয়ে দরকার বেশি সেবাযত্নের।

 বড় ডাক্তার? হারানের চেয়ে বড় ডাক্তার কে আছে শ্যামা তো জানে