পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৩৭

হারান কি কখনো তা ভাবে? স্নেহ মনে করিয়া শ্যামা পাছে কাছে ঘেঁষিতে চায়, শ্যামা পাছে মনে করে অযাচিত দানের পিছনে হারানের মমতার উৎস লুকাইয়া আছে, আত্মীয়তা দাবী করার সুযোগ পাছে শ্যামাকে দেওয়া হয়, তাই না হারান তাহার দানকে শ্যামার প্রাপ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল।

 অভিমানে শ্যামার কান্না আসে। অভিমানে কান্না আসিবার বয়স তাহার নয় তবু মনের মধ্যে আজো যে অবুঝ কাঁচা মেয়েটা লুকাইয়া আছে, যে বাপের স্নেহ জানে নাই, অসময়ে মাকে হারাইয়াছে, ষোল বছর বয়স হইতে জগতে একমাত্র আপনার জন মামাকে খুঁজিয়া পায় নাই, স্বামীর ভয়ে দিশেহারা হইয়া থাকিয়াছে, সে যদি আজ কাঁদিতে চায় প্রৌঢ়া শ্যামা তাহাকে বারণ করিতে পারিবে কেন?

 তাহারা বনগাঁ পৌঁছিলে মন্দা শীতলকে দেখিয়া একটু কাঁদিল তারপর তাড়াতাড়ি তার জন্য বিছানা পাতিয়া দিল। এদিক ওদিক ছুটাছুটি করিয়া ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িল। সে সেবাযত্নের ব্যবস্থা করিল, ছেলেমেয়েদের সরাইয়া দিল, শ্যামাকে বলিতে লাগিল, ভেবো না তুমি বৌ, ভেবো না,—ফিরে যখন পেয়েছি দাদাকে ভাল করে আমি তুলবই।

 বকুল বিস্ফারিত চোখে শীতলকে খানিকক্ষণ চাহিয়া দেখিল, তারপর সে যে কোথায় গেল, কেহ আর তাহাকে খুঁজিয়া পায় না। হারান ডাক্তারকেও নয়। কোথায় গেল দুজনে? শেষে সুপ্রভাই তাদের আবিষ্কার করিল বাড়ির পিছনে ঢেঁকিঘরে। ওঘরে বকুল খেলাঘর পাতিয়াছে। ঢেঁকিটার উপরে পাশাপাশি বসিয়া গম্ভীর মুখে কি যে তাহারা আলোচনা করিতেছিল তারাই জানে, সুপ্রভা দেখিয়া হাসিয়া বাঁচে না। ডাক্তার নাকি বুড়া? জগতে এত জায়গা থাকিতে, কথা বলিবার এত লোক থাকিতে বুড়া ঢেঁকিঘরে বসিয়া আলাপ করিতেছে বকুলের সঙ্গে।

 যা তো খোকা, ডেকে আন ওদের। বুড়োকে বল মুখ হাত ধুয়ে নিতে, খেতে টেতে দি। তোর বাবা কি খাবে তাও তো বলে দিলে না, ঢেঁকিঘরে গিয়ে বসে রয়েছে?

 হারান আসে, মুখে হাত ধোয়, সুপ্রভা ঘোমটা টানিয়া তাহাকে জলখাবার দেয়। বকুল কিন্তু ঢেঁকিঘরেই বসিয়া থাকে। সুপ্রভা গিয়া বলে, ও