পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৫৭

এ স্বপ্নের খবর বিধানের চেয়ে কে ভাল করিয়া রাখে? তাই পড়া ছাড়িয়া চাকরি লইয়াছে, চিঠিতে শ্যামাকে একথা লিখিতে বিধানের ভয় হইয়াছিল। শুধু তাই নয়। বিধান ভাবিয়াছিল সে দু'শ চারশ' টাকার চাকরি করিবে এই প্রত্যাশায় শ্যামা দিন গুনিতেছে, নব্বই টাকার চাকরি শুনিয়া সে যদি ক্ষেপিয়া যায়?

 পরীক্ষা পর্যন্ত আরও একটা বছর ছেলের পড়ার খরচ দিতে পারিবে না ভাবিয়াই শ্যামা যে ক্ষেপিয়া যাইতে বসিয়াছিল, বিধান তো তাহা জানিত না। চাকরিটা তাহার নব্বই টাকার শুনিয়াই শ্যামা এমনভাবে কৃতার্থ হইয়া গেল যে বিধান অবাক হইয়া রহিল। সন্দিগ্ধভাবে সে জিজ্ঞাসা করিল, খুসি হওনি মা তুমি?

 খুসি হয় নাই।—খুসিতে শ্যামা আবোল তাবোল বকিতে আরম্ভ করে। এতকাল শ্যামাকে যারা অবহেলা অপমান করিয়াছে তাদের টিটকারি দেয়। কলিকাতায় মস্ত বাড়ি ভাড়া নেয়, বকুলকে আনে, বিধানের বিবাহ দেয়, দাস দাসীতে ঘরবাড়ি ভরিয়া ফেলে। তারপর হাসিমুখে সকলকে ডাকিয়া বিধানের চাকরির কথা শোনায়। তার দুধের ছেলে নব্বই টাকার চাকরি যোগাড় করিয়াছে, কারো সাহায্য চায় নাই, কারো তোষামোদ করে নাই—বল তো বাছা এবার তাদের মুখ রইল কোথায় ছেলেকে আমার পড়ার খরচটুকু পর্যন্ত যারা দিতে চায় নি? কথাবার্তা শুনিয়া মনে হয় শ্যামা সত্যই বড় অকৃতজ্ঞ। এতগুলি বছর যার আশ্রয়ে সে থাকিয়াছে, এখন ছেলের চাকরি হওয়ামাত্র নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে তার। এরা যে কত করিয়াছে তার জন্য সব সে ভুলিয়া গিয়াছে, মনে রাখিয়াছে শুধু ত্রুটি বিচ্যুতি, অপমান অবহেলা। মন্দা রাগিয়া বলে, ধন্যি তুমি বৌ, এতও ছিল তোমার পেটে পেটে। এত যদি কষ্ট পেয়েছ তুমি এখেনে থেকে থাকলে কেন? নিজের রাজ্যপাটে গিয়ে বসলে না কেন রাজরাণী হয়ে? আজ পাঁচ বছর তোমাদের পাঁচটি প্রাণীকে আমি পুষলাম, ছেলে পড়ালাম, মেয়ে বিয়ে দিলাম তোমার, আজ দিন পেয়ে আমাদের তুমি শাপছ!

 অবাক হইয়া শুনিয়া শ্যামা কাঁদিতে কাঁদিতে বলে, না ঠাকুরঝি, তোমাদের কিছু বলিনি তো আমি, কেন বলব তোমাদের? কম করেছ আমার