পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৫৯

 পাগল হওয়ার আর কোন লক্ষণ শ্যামার দেখা গেল না, সেদিন ঘুমাইলা উঠিয়া তার যে অসাধারণ নীরবতা আসিয়াছিল তাই শুধু কায়েমি হইয়া রহিল। আর যেন তাহার কোন বিষয়ে দায়িত্ব নাই, মতামত নাই, সে মুক্তি পাইয়াছে। জীবন যুদ্ধ তাহার শেষ হইয়া গিয়াছে। এবার বিধান লড়াই চালাক, বিধান সব ব্যবস্থা করুক, সংসারের ভাল মন্দের দায়িত্ব থাক বিধানের। শ্যামা কিছু জানে না, জানিতে চাহে না,—ঘরের মধ্যে অন্তঃপুরের গোপনতায় তার যা কাজ এবার তাই শুধু সে করিবে: উপকরণ থাকিলে রাঁধিয়া দিবে পোলাউ, না থাকিলে দিবে শাক ভাত। বিধান তাহাকে এখানে রাখিলে এখানেই সে থাকিবে, কলিকাতা লইয়া গেলে কলিকাতা যাইবে। সব সমান শ্যামার কাছে। বিধানের চাকুরি-লাভও শ্যামার কাছে যেন আর উল্লাসের ব্যাপার নয়, খুবই সাধারণ ঘটনা। এই তো নিয়ম সংসারের? স্বামী পুত্র উপার্জন করে, স্ত্রী ও জননী ভাত রাঁধে। আর ভালবাসে। আর সেবা-যত্ন করে। আর নির্ভয় নিশ্চিন্ত হইয়া থাকে অক্ষয় অমর একটি নির্ভরে।


 শহরতলীতে নয় এবার খাস কলিকাতায় নূতন বাড়িতে শ্যামা নূতন সংসার পাতিল। বাড়িটা নূতন সন্দেহ নাই, এখনো রঙের গন্ধ মেলে। দোতালা বাড়ি, একতলাতে বাড়িওলা থাকে। দোতালার মাঝামাঝি কাঠের ব্যবধান, প্রত্যেক ভাগে দু'খানা ঘর। রান্নার জন্য ছাদে দুটি ছোট ছোট টিনের চালা। শ্যামারা থাকে দোতালার সামনের অংশটিতে, রাস্তার উপরে ছোট একটু বারান্দা আছে। একটি স্বামী ও দু'টি কন্যা সহ অপর অংশে বাস করে শ্রীমতী সরযূবালা দে, পাশকরা ধাত্রী।

 সরযূ যেমন বেঁটে তেমনি মোটা, ফুটবলের মত দেখিতে। দেহের ভারেই সে যেন সব সময় হাঁপায়। কাজে যাওয়ার সময় সে যখন সাদা কাপড় ঢাকা রিক্সয় চাপে আর শীর্ণকায় কুলিটি রিক্স টানিয়া লইয়া যায় উপর হইতে দেখিয়া শ্যামা হাসি চাপিতে পারে না।

 সরযূর মেয়ে দুটি সুন্দরী। বড় মেয়েটির নাম বিভা। বিধানের সে সমবয়সীই হইবে—মেয়ে স্কুলে গান শেখায়। ছোট মেয়েটির নাম শামু, বিধানের বৌ হইলে মানায় এমনি বয়স, পড়ে স্কুলে। সরযূর সাধ শামুকে