পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৮
জননী

পর নয় তবু আজ মোহিনী যেন বিশেষ করিয়া আপন হইয়া যায়। মনটা ভাল মোহিনীর, বকুলের জন্য টান আছে মোহিনীর, না আসুক সে নিমন্ত্রণ না করিলে, অবুঝ গোঁয়ার সে নয়। মধুর স্বভাব তার।

 চার পাঁচদিন পরে বিধান গিয়া বকুলকে লইয়া আসিল। বলিল, উঃ মাগো কি গালটা পিসি আমাকে দিলে। বাড়িতে পা দেয়া থেকে সেই যে বুড়ি মুখ ছুটাল মা, থামল গিয়ে একেবারে বিদায় দেবার সময়। অমঙ্গল হবে ভেবে তখন বোধ হয় কিছু বলতে সাহস হ'ল না। মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আর যাচ্ছিনে বাবু খুকির শ্বশুরবাড়ি এ জন্মে।

 বকুল তো আসিল, এ কোন বকুল? একি রোগা শরীর বকুলের! নিষ্প্রভ কপোল, ভীরু চোখ, কান্তিবিহীন মুখ, লাবণ্যহীন বর্ণ—মেয়েকে তার এমন করিয়া দিয়াছে ওরা।—পেট ভরে খেতেও ওরা তোকে দিত না বুঝি খুকি? খাটিয়ে মারত বুঝি তোকে দিনরাত? আমি কি জানতাম মা এত তোকে কষ্ট দিচ্ছে। আনবার জন্যে লিখতিস, ভাবতাম আসবার জন্যে মন কেমন করছে তাই ব্যাকুল হয়েছিস,—পোড়া কপাল আমার।

 শ্যামার মুখে হঠাৎ যে খিল পড়িয়াছিল বকুল আসিয়া যেন তা খুলিয়া দিয়াছে। সেটা আশ্চর্য নয়। মনের অবস্থা অস্বাভাবিক হইয়া আসিলে এই তো তার সবার বড় চিকিৎসা, এমনি ভাবে মশগুল হইতে পারা জীবনের স্বাভাবিক বিপদে সম্পদে যার মহা সমন্বয় সংসারধর্ম। বহু দিনের দুর্ভাবনায়, বনগাঁর পরাশ্রিত জীবনযাপনে, শ্যামার মনে যদি বৈকল্য আসিয়া থাকে, ছেলেব চাকরি, অন্ধ মেয়ের জন্ম, বকুলের এভাবে আসিয়া পড়া, এততেও সেটুকু কি শোধরাইবে না? আগের মত হওয়া শ্যামার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তবু পরিবর্তিত পরিশ্রান্ত ক্ষয় পাওয়া শ্যামার মধ্যে একটু শক্তি ও উৎসাহ, একটু চাঞ্চল্য ও মুখরতা এখন আসিতে পারে, আসিতে পারে জীবনের হাসি-কান্নার আরও তেজী মোহ সুখের নিবিড়তর স্বাদ।

 মহোৎসাহে শ্যামা বকুলের সেবা আরম্ভ করিল।

 বনগাঁয়ে চুরি করিয়া বিধানকে সে ভাল জিনিস খাওয়াইত, এখানে নিজের মুখের খাবারটুকু সে মেয়ের মুখে তুলিয়া দিতে লাগিল। নব্বই টাকা আয়ে তো কলিকাতা শহরে রাজার হালে থাকা যায় না, নিজেকে বঞ্চিত না