পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৭৩

পৌঁছাইয়া দেয়। এখন এসব ছোটখাট উপকার কে না কার করে জগতে? বাড়ির কাজও তো সে কম করে না। বিভার দুটি একটি কাজ করিয়া দেওয়ার মধ্যে তার গোপন মনের প্রতিচ্ছবি যে সকলে দেখিয়া ফেলিবে কেমন করিয়া সেটুকু অনুমান করিবে বনবিহারী? বিভার যে ফটোখানা সে চুরি করিয়াছে, সেখানা সে লুকাইয়া রাখিয়াছে ক্যানভাসিংএ যাওয়ার সুটকেশটির মধ্যে, আর পুরোনো ব্লাউজটি রাখিয়াছে তার ট্রাঙ্কে তালাচাবি দিয়া। চুপি চুপি লুকাইয়া এগুলি সকলে যে আবিষ্কার করিয়াছে তাই বা সে জানিবে কিরূপে?

 বিভা বিব্রত হইয়া থাকে। বনবিহারী এমন নিরীহ, যত স্পষ্টই হোক এমন মূক ও নিষ্ক্রিয় তার প্রেম, তার বিরুদ্ধে নালিশ খাড়া করিবার তুচ্ছতম প্রমাণটিরও এমন অভাব যে এ বিষয়ে সকলের যেমন তারও তেমনি কিছু বলিবার অথবা করিবার উপায় নাই। মনে মনে সে কখনো রাগে কখনো বোধ করে মমতা। সিঁড়ি দিয়া নামার সময় কোনদিন তাকায় ক্রুদ্ধ ভর্ৎসনার চোখে, কোন দিন দুটি একটি স্নিগ্ধ কথা বলে। ভাল যে লাগে না একেবারে তা নয়। একটা কুকুরও কুকুরের মত পোষ মানিলে মানুষের তাতে কত গর্ব— কত আনন্দ, এতো একটা মানুষ। অথচ এরকম পূজা গ্রহণ করিবার উপায় না থাকিলে কি বিশ্রীই যে লাগে মানুষের মনে যার একফোঁটা দয়ামায়া থাকে।

 বকুলের সঙ্গে হাসাহাসি করে বটে মনে মনে শ্যামা কিন্তু ব্যথা পায়। শক্ত সমর্থ যুবক, একি ব্যাধি তার মনের। মেরুদণ্ডটা পর্যন্ত যে ওর গলিয়া গেল। সুযোগ পাইয়া কি ব্যবহারটাই বাড়ির লোকে করে ওর সঙ্গে! নিজের মনুষ্যত্ব যে বিসর্জন দিয়াছে কে তাকে মানুষ জ্ঞান করিবে, দোষ কারো নাই।

 আচ্ছা শামুর জন্য বিধানও যদি অমনি হইয়া যায়? অমনি উন্মাদ? ও ভগবান শ্যামা তবে নিজেই পাগল হইয়া যাইবে।

 অনেক ভাবিয়া শ্যামা শেষে একদিন বকুলকে বলে, শোন খুকী, বলি দ্যাখ শামুকে যদি খোকার পছন্দ হয়ে থাকে, ওর সঙ্গেই না হয় দিই খোকার বিয়ে? স্বঘর তো, দোষ কি?

 বকুল স্তম্ভিত হইযা যায়। বলে ক্ষেপেছ নাকি তুমি মা? কি বলছ তার ঠিক ঠিকানা নেই। ওই মেয়ের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও দাদার! শামু