পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৬
জননী

ভাবিলে বকুলের মেয়ের চোখ দুটির যদি কিছু হয়। প্রথম সন্তান বকুলের, বড় সে আঘাত পাইবে।

 মেয়ের দুমাস বয়স করিয়া বকুল শ্বশুর বাড়ি গেল। যাওয়ার আগে কি কান্নাই যে বকুল কাঁদিল। বলিল, চেহারা তোমার বড্ড খারাপ হয়েছে মা, এবার তাকাও একটু শরীরের দিকে, এখনও এত খাটুনি তোমার সইবে কেন এ শরীরে? বিয়ে দিয়ে বৌ আনো এবার দাদার, সারাজীবন তো প্রাণ দিয়ে করলে সকলের জন্যে, এবার যদি না একটু সুখ করে নেবে—

 বলিল, আমার যেমন কপাল! সেবা নিয়েই চললাম, তোমার কাছে থেকে একটু যে যত্ন করব তা কপালে নেই।

 কি গিন্নিই বকুল হইয়াছে। ছাঁচে ঢালা হইয়া আসিতেছে তাহার চালচলন, কথার ধরণ। যেন দ্বিতীয় শ্যামা।

 শীতকাল। বকুল শ্বশুরবাড়ি গেল শীতকালে। শীতে সংসারের কাজ করিতে এবছর শ্যামার সত্যই যেন কষ্ট হইতে লাগিল। ছেলেকে আপিসের ভাত দিতে হয়, শীতের সকাল দেখিতে দেখিতে বেলা হইয়া যায়, খুব ভোরে উঠিতে হয় শ্যামার। আগুনের আঁচে রান্না করিয়া আসিয়া রাত্রে লেপের নিচে গা যেন শ্যামার গরম হইতে চায় না, যত সে জড়সড় হইয়া শোয় হাতে পায়ে কেমন একটা মোচড় দেওয়া ব্যথা জাগে, কেমন একটা কষ্ট হয় তাহার। ভোরে এই কষ্ট দেহে লইয়া সে লেপের বাহিরে আসে, আঁচল গায়ে জড়াইয়া হিহি করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে নিচে যায়। ঠিকা ঝি আসিবে বেলায়, তার আগে কিছু কিছু কাজ শ্যামাকে আগাইয়া রাখিতে হয়। বিধান বাহিরের ঘরে শোয়। ঝি আসিয়া ডাকাডাকি করিলে তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়—শ্যামা তাই আগে সন্তর্পণে সদর দরজাটা খুলিয়া রাখিয়া আসে। ঘুম সে ভাঙ্গায় মণির। মণির পরীক্ষা আসিতেছে, নিচের যে ঘরে আগে শ্যামা সকলকে লইয়া থাকিত, সেই ঘরে মণি একা থাকে—পড়াশোনা করে, ঘুমায়। ভোর ভোর ছেলেকে ডাকিয়া তুলিতে বড় মমতা হয় শ্যামার। কিন্তু আজও তো তার কাছে ভবিষ্যতের চেয়ে বড় কিছু নাই, জোর করিয়া মণিকে সে তুলিয়া দেয়। বলে, ওঠ্ বাবা ওঠ্, না পড়লে পরীক্ষায় যে ভাল নম্বর পাবিনে?