পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৮৯

 শ্যামা আগাইয়া গেল, বলিল, বৌমা, কিছু খাওনি বিকেলে, এসো তোমায় খেতে দি।


 নতুন বৌএর আর ভাল মন্দ কি, সে তো শুধু একতাল লজ্জা ভয় নম্রতা, তবু ওর মধ্যেই মনটা বোঝা যায়, সরল না কুটিল, কুড়ে না কাজের লোক। মা-হারা মেয়ে? কথাটা শ্যামার মনে থাকে না,—তুমিই আমার হারাণো মা, বলিয়া শ্যামার স্নেহের ভাণ্ডারে ডাকাতি করিবার মেয়েও সুবর্ণ নয়, সে সরল কিন্তু বুদ্ধিমতী, কাজের মানুষ কিন্তু কুলরমণী নয়। দরকার মত একখানা দুখানা বাসন সে বাসন-মাজার মতই মাজিয়া আনে, কাজটুকু করিতে পাইয়া এমন উৎফুল্ল হইয়া ওঠে না যে মনে হইবে পুষ্প-চয়ন করিতে পাইয়াছে। শাশুড়ীর হাতের কাজ কাড়িয়া যে বৌ কাজ করে কোনো শাশুড়ীই তাকে দেখিতে পারে না, সুবর্ণ সে চেষ্টা করে না, স্বাভাবিক নিয়মে যে সব কাজ শ্যামার হাত হইতে খসিয়া তাহার হাতে আসে, মন দিয়া সেইগুলিই সে করিয়া যায়, আর একটি সজাগ দৃষ্টি পাতিয়া রাখে শ্যামার মুখে, আলো নিভিয়া মেঘ ঘনাইয়া আসিবার উপক্রমেই চালাক মেয়েটা ত্রুটি সংশোধন করিয়া ফেলে।

 নেহাৎ দোষ করিয়া ফেলিলে প্রয়োগ করে একেবারে চরম অস্ত্র। চোখ দুটো জলে টাবুটুবু ভর্তি করিয়া শ্যামার সামনে মেলিয়া ধরে। ভাল করিয়া সুরু করার আগেই শ্যামার মুখের কথাগুলি জমিয়া যায়।

 শ্যামা হঠাৎ সুর বদলাইয়া সস্নেহে হাসিয়া বলে, আ আবাগের বেটি, এই কথাতে চোখে জল এল! কি আর বলেছি মা তোকে এ্যাঁ?

 চোখ! অশ্রুসজল চোখকে শ্যামা বড় ডরায়। মানুষের চোখের সম্বন্ধে সে বড় সচেতন। চোখ ছিল তার বকুলের আর চোখ হইয়াছে বকুলের মেয়েটার! শ্যামার মেয়েটি অন্ধ, এত যে আলো জগতে একটি রেখাও তার খুকির চেতনায় পৌঁছায় না। সজল চোখে চাহিয়া যে-কোন দৃষ্টিমতী শ্যামাকে সম্মোহন করিতে পারে।

 বড় দোটানায় পড়িয়াছে শ্যামা।

 ছেলের বৌটাকে ভালবাসিবে কি বাসিবে না।