পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯২
জননী

একটি অঙ্গ গ্রাস করিয়া, সর্বাঙ্গের প্রায় সবটুকু শক্তি শুষিয়া তৃপ্ত হইয়া আছে, হঠাৎ কবে আবার ক্ষুধা জাগিবে এখনো কেহ তাহা বলিতে পারে না।

 শ্যামা বলে, হ্যাঁ গা, বড় কি কষ্ট হচ্ছে? কি করবে বল দেখি? বৌমা বসবে একটু কাছে? গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে? কোন্‌খানে কষ্ট তোমার? ও মণি ডাকতো তোর বৌদিকে, ওষুদ মালিশ করে দিয়ে যাক—কোথায় যে যায়, ফাঁক পেয়েছে কি ছেলের সঙ্গে ফুসফাস গুজগাজ করতে চলল—কি মন্ত্র দিচ্ছে কানে কে জানে!

 সুবর্ণ ওষুদ মালিশ করিতে বসে।

 শ্যামা বলে, দেখ তো মণি ও-বাড়ির ছাদে কে? নকুড়বাবুর বাঁশি বাজানে ভাইটে বুঝি? দেতো দরজাটা ভেজিয়ে,—বৌমা, আরেকটু সামলে সামলেই না হয় বসতে বাছা, একটু বেশি লজ্জা থাকলে ক্ষেতি নেই কারো।

 সুবর্ণ জড়সড় হইয়া যায়, রাঙা মুখ নত করে। শ্যামা যখন এমনিভাবে বলে কোন উপায়ে মিশাইয়া যাওয়া যায় না শূন্যে?

 ভাল লাগে না, বলিয়া শ্যামারও ভাল লাগে না! সুবর্ণের ম্লান মুখখানা দেখিয়া কত কি সে ভাবে। ভাবে, সে যদি আজ ওমনি বৌ হইত এবং আর কেহ যদি ওমনি করিয়া তাকে বলিত, কেমন লাগিত তার? বিধানের কানে গেলে কত ব্যথা পাইবে সে! মণি বড় হইতেছে, কথাগুলি তার মনে না-জানি কি ভাবে কাজ করে! একি স্বভাব, একি জিহ্বা হইয়াছে তার? কেন সে না বলিয়া থাকিতে পারে না? শ্যামা বাহিরে যায়। বর্ষার মেঘলা দিন। ধানকলের অঙ্গনে আর ধান মেলিয়া দেয় না, অতবড় অঙ্গনটা জনহীন, কুলিরমণী নাই, পায়রার ঝাঁক নাই। খুকিকে শ্যামা বুকের কাছে আরও উঁচুতে তুলিয়া ধরে। বিধানের বৌকে কি কটু কথা শ্যামা বলিয়াছে, কি বিষাদ শ্যামার মনে—দিগদিগন্ত চোখের জলে ঝাপ্সা হইয়া গেল।

 আশ্বিনের গোড়ায় হারাধন মেয়েকে লইয়া গেল।

 যাওয়ার সময় সুবর্ণ অবিকল মা-হারা মেয়ের মতই ব্যবহার করিয়া গেল। শ্যামা ভালবাসে না, শ্যামা কটু কথা বলে, তবু মনে হইল সুবর্ণ