পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
জননী

মনে যখন তাহার দোলা লাগে। খেলার অর্থহীন হাত নাড়া আর ক্ষুধার সময় স্তন খুঁজিয়া হাত-নাড়ার পার্থক্য লক্ষ্য করিয়া তাহার যখন সকলকে ডাকিয়া এ ব্যাপার দেখাইতে ইচ্ছা হয় শ্যামা তখন নিজেকে সতর্ক করিয়া দেয়। স্মরণ করে যে সন্তানকে উপলক্ষ করিয়া জননীর অসংযত উল্লাস অমঙ্গলজনক। আনন্দের একটা সীমা ভগবান মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, মানুষ তাহা লঙ্ঘন করিলে তিনি রাগ করেন। তবু সব সময় শ্যামা কি আর নিজেকে সামলাইয়া চলিতে পারে? অন্যমনস্ক অবস্থায় হঠাৎ একসময় ঝাঁ করিয়া খোকাকে সে কোলে তুলিয়া লয়। তাহার পাজরের একদিকে থাকে হৃৎপিণ্ড আরেক দিকে থাকে খােকা। খোকার লালিম পা দুটি হইতে কেশ বিরল মাথাটি পর্যন্ত শ্যামা অসংখ্য চুম্বন করে দীর্ঘনিশ্বাসে খােকার দেহেব আঘ্রাণ লয়। তারপর সে অনুতাপ করে। বাড়াবাড়ি করিয়া একবার তাহার সর্বনাশ হইয়াছে তবু কি শিক্ষা হইল না?

 শীতলের মিশ্র খাপছাড়া প্রকৃতিতেও বাৎসল্যের আবির্ভাব হইযাছে। বাৎসল্যের বসে তাহার ভীরু উগ্রতাও যেন একটু নরম হইয়া আসিয়াছে। পিতৃত্বের অধিকার খাটাইয়া ছেলের সঙ্গে সে একটু মাখামাখি করিতে চায়, শ্যামা সভয়ে বাধা দিলে রাগ করার বদলে ক্ষুণ্ণই যেন হয়—প্রকৃতপক্ষে রাগ করার বদলে ক্ষুণ্ণ হয় বলিয়াই তাহার বিপজ্জনক আদরের হাত হইতে ছেলেকে বাঁচাইয়া চলিবার সাহস শ্যামার হয়। সে উপস্থিত না থাকিলে ছেলেকে কোলে তুলিতে শীতলকে সে বারণ করিয়া দিয়াছে। মাঝে মাঝে দুচার মিনিটের জন্য ছেলেকে স্বামীর কোলে সে দেয় কিন্তু নিজে কাছে দাঁড়াইয়া থাকে, পুলিসের মত সতর্ক পাহারা দেয়।

 মাঝে মাঝে শীতল তাহাকে ফাঁকি দিবার চেষ্টা করে। রাত্রে হয়ত সে জাগিয়া আছে, খােকা কাঁদিল। চুপি চুপি চৌকি হইতে নামিয়া মেঝেতে পাতা বিছানায় ঘুমন্ত শ্যামার পাশ হইতে খােকাকে সে সন্তর্পণে তুলিয়া লয়—চোরের মত। অনভ্যস্ত অপটু হাতে খোকাকে বুকের কাছে ধরিয়া রাখিয়া নিজে সামনে পিছনে দুলিয়া তাহাকে সে দোলা দেয়, মৃদু গুনগুনানাে সুরে ঘুমপাড়ানাে ছড়া কাটে। বলে—আয় রে পাড়ার ছেলেরা মাছ ধরতে যাই, মাছের কাঁটা পায় ফুটেছে, দোলায় চড়ে যাই। রাতদুপুরে নিজের মুখে ঘুম-