পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২
জননী

আর তাহা হইবার উপায় নাই—সাংসারিক ব্যাপারে ও ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে শ্যামার সঙ্গে তাহার কতগুলি মত ও অনুভূতি খাপ খায় মাত্র। শ্যামার কাছে বেশি আর কিছু আশা করা যায় না। অথচ এদিকে বাহিরে মদ খাইয়া একা একা স্ফূর্তিও জমে না, সব কি রকম নিরানন্দ অসার মনে হয়। অনেক প্রত্যাশা করিয়া হয়ত সে তাহার পরিচিত কোন মেয়ের বাড়ি যায়, কিন্তু নিজের মনে আনন্দ না থাকিলে পরে কেন আনন্দ দিতে পারিবে, তাও টাকার বিনিময়ে? আজকাল হাজার মদ গিলিয়াও নেশা পর্যন্ত যেন জমিতে চায় না, কেবল কান্না আসে। কত কি দুঃখ উথলিয়া ওঠে।

 এক একদিন সে করে কি, সকাল সকাল প্রেস হইতে বাড়ি ফেরে। শ্যামার রান্নার সময় সে ছেলেমেয়েদের সামলায়, বারান্দায় পায়চারি করিয়া ছোট খোকমণিকে ঘুম পাড়ায়, মুখের কাছে বাটি ধরিয়া বকুকে খাওয়ায় দুধ। বকুকে কোলে করিয়া ঘুম পাড়াইতে হয় না, সে বিছানায় শুইয়াই ঘুমায়, ঘুমাইয়া পড়িবার আগে একজনকে শুধু তাহার পিঠে আস্তে আস্তে চুলকাইয়া দিতে হয়। তারপর বাকি থাকে বিধান। সে খানিকক্ষণ পড়ে, তারপর তাহাকে গল্প বলিয়া রান্না শেষ হওয়া পর্যন্ত জাগাইয়া রাখিতে হয়। এসব শীতল অনেকটা নিখুঁতভাবেই করে। সকলের খাওয়া শেষ হইলে গর্বিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে তামাক টানিতে টানিতে শ্যামার কি বলিবার আছে শুনিবার প্রতীক্ষা করে। শ্যামার কাছে সে কিছু প্রশংসার আশা করে বৈকি! শ্যামা কিন্তু কিছু বলে না। তাহার ভাব দেখিয়া মনে হয় সে রান্না করিয়াছে, শীতল ছেলে রাখিয়াছে, কোন পক্ষেরই এতে কিছু বাহাদুরি নাই।

 শেষে শীতল বলে, কি দুষ্টুই যে ওরা হয়েছে শ্যামা, সামলাতে হয়রাণ হয়ে গেছি—ওদের নিয়ে তুমি রান্না কর কি করে?

 শ্যামা বলে, মণিকে ঘুম পাড়িয়ে নি, বুকুকে খোকা রাখে।

 এত সহজ? শীতল বড় দমিয়া যায়, সন্ধ্যা হইতে ওদের সামলাইতে সে হিমসিম খাইয়া গেল, শ্যামা এমন অবলীলাক্রমে তাহাদের ব্যবস্থা করে?

 শ্যামা হাই তুলিয়া বলে, এক একদিন কিন্তু ভারি মুস্কিলে পড়ি বাবু, মণি ঘুমােয় না, বুকুটা ঘ্যান ঘ্যান করে, সবাই মিলে আমাকে ওরা খেয়ে ফেলতে চায়,—মরেও তেমনি মার খেয়ে। তুমি বাড়ি থাকলে বাঁচি,