পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪
জননী

গােসাঘর আছে, সেইখানে নিজেকে গুঁজিয়া দিয়া সে কাঁদে। তারপর গােসাঘরখানাকে পুতুলের ঘর বানাইয়া সে খেলা করে। যে পুতুলটি তাহার ছেলের বৌ তার সঙ্গে বকুলের বড় ভাব, দুজনে যেন সই। তাকে শােনাইয়া সে সব মনের কথা বলে। বলে, বাবাকে সব বলে দেব, বাবা দাদাকে মারবে, মাকেও মারবে, মারবে না ভাই বৌমা? এ্যাঁ করে জিব বের করে দাদা মরে যাবে—মা কেঁদে মরবে, হুঁ।

 শীতলের কি হইয়াছে শ্যামা বুঝিতে পারে না, লােকটা কেমন যেন ভোঁতা হইয়া গিয়াছে, স্মৃতিও নাই দুঃখও নাই। সমহমত আপিসে যায়, সময়মত ফিরিয়া আসে, কোনদিন পাড়ার অখিল দত্তের বাড়ি দাবা খেলিতে যায়, কোনদিন বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে রাগারাগিও করে না, দীনদুঃখীর মত মুখের ভাবও করিয়া রাখে না। স্ত্রী ও পুত্রকন্যার সঙ্গে তাহার কথা ও ব্যবহার সহজ ও স্বাভাবিক হয়, অথচ তার কাছে কারো যেন মূল্য নাই, কিছুই সে যেন গ্রাহ্য করে না। শ্যামার টাকা লইয়া পালানোর পর হইতে তাহার এই পাগলামি-না-করার পাগলামি আরম্ভ হইয়াছে। ধার করিয়া রাখালকে টাকা দেওয়ার অপরাধ, শ্যামার জমানাে টাকাগুলি নষ্ট করার অপরাধ, তাহার কাছে অবশ্যই পুরনাে হইয়া গিয়াছে, মনে আছে কিনা তাও সন্দেহ। মাস গেলে আগের টাকার অর্ধেক পরিমাণ টাকা আনিয়া সে শ্যামাকে দেয়, আগে হইলে এই লইয়া কত কাণ্ড করিত, হয় অনুতাপে সারা হইত, না হয় নিজে নিজে কলহ বাঁধাইয়া শ্যামাকে গাল দিয়া বলিত, যা সে আনিয়া দেয় তাই যেন শ্যামা সােনামুখ করিয়া গ্রহণ করব, ঘরে বসিয়া গেলা যাহার একমাত্র কর্ম অত তাহার টাকার খাঁকতি কেন?—এখন টেরও পাওয়া যায় না কম টাকা আনিয়াছে এটা সে খেয়াল করিয়াছে। শ্যামা যদি নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, কি করে যে মাস চালাব,—সে অমনি অমায়িক ভাবে বলিয়া বসে, ওতেই হবে গাে, খুব চলে যাবে, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, ইয়ে করতে হয় না, কি কর অত টাকা?

 কমল ঘােষের টাকাটা মাসে মাসে কিছু কম করিয়া দিলে হয়ত চলে, শীতলকে এ কথা বলিতে শ্যামার বাধে। ঋণ যত শীঘ্র শােধ হইয়া যায় ততই ভাল। এদিকে খরচ চলিতে চাহে না। বিধানকে স্কুলে দেওয়ার পর খরচ