পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৫৫

বাড়িয়াছে, বই খাতা, স্কুলের মাহিনা, পােষাক, জলখাবারের পয়সা এ সব মিলিয়া অনেকগুলি টাকা বাহির হইয়া যায়। যেমন তেমন করিয়া ছেলেকে শ্যামা স্কুলে পাঠাইতে পারে না, ছেলের পরিচ্ছদ ও পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে বিষ্ণুপ্রিয়া যে তাহাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল, নিতান্ত অভাবের সময়েও শ্যামা তাহা অগ্রাহ্য করিতে পারে না। খরচ সে কমাইয়াছে অন্য দিকে। সত্যভামার এতকালের চাকুরিটি গিযাছে। নিজের জন্য সেমিজ ও কাপড় কেনা শ্যামা বন্ধ করিয়াছে, এ সব বেশি পরিমাণে তাহার কোন দিনই ছিল না, চিরকাল জোড়াতালি দিয়া কাজ চালাইয়া আসিয়াছে, এখন বড় অসুবিধা হয়। স্বামীপুত্র ছাড়া বাড়িতে কেহ থাকে না তাই রক্ষা, নতুবা লজ্জা বাঁচিত না। শীতল আব বিধান বাহিরে যায়, ওদের জামা কাপড় ছাড়া শ্যামা আর কিছু ধােপাবাড়ি পাঠায় না, বাড়িতে কাচিয়া লয়। ছেলেমেযেদের দুধ সে কমাইতে পারে নাই, কমাইয়াছে মাছের পবিমাণ। মাঝে মাঝে ফল ও মিষ্টি আনাইয়া সকলকে খাওয়ানাের সাধ সে ত্যাগ করিয়াছে। এই ত্যাগটাই সব চেয়ে কষ্টকর। শ্যামার ছেলেমেয়েবা ভাল জিনিস খাইতে বড় ভালবাসে।

 তবু এই সব অভাব অনটনেব মধ্যেও শ্যামার দিনগুলি সুখে কাটিয়া যায়। ছেলেমেয়েদের অসুখ বিসুখ নাই। শীতলের যাহাই হইয়া থাক তাহাকে সামলাইয়া চলা সহজ। নিজের শরীরটাও শ্যামার এত ভাল আছে যে একা সংসারের সমস্ত খাটুনি খাটিতে তার কিছুমাত্র কষ্ট হয় না। কাজ করিতে যেন ভালই লাগে।

 চৈত্র শেষ হইয়া আসিল। ছাদে দাঁড়াইলে বসাকদের বাড়ির পাশ দিয়া রেলের উঁচু বাঁধটার ধারে প্রকাণ্ড শিমুল গাছটা হইতে তুলা উড়িয়া যাইতে দেখা যায়। পরে খানিকটা ফাঁকা মাঠের পরে টিনের বেড়ার ওপাশে ধানকলের প্রকাণ্ড পাকা অঙ্গন। কুলি মেয়েরা প্রত্যহ ধান মেলিয়া শুকাইতে দেয়, ধান খাইতে ঝাঁক বাঁধিয়া পায়রা নামিয়া আসে। পায়রার ঝাঁকের ওড়া দেখিতে শ্যামা বড় ভালবাসে, অতগুলি পাখি আকাশে বারবার দিক পরিবর্তন করে এক সঙ্গে, সকাল ও বিকাল হইলে উড়িবার সময় একসঙ্গে সবগুলি পায়রার পাখার নিচে রােদ লাগিয়া ঝকঝক করিয়া ওঠে, শ্যামা অবাক হইয়া ভাবে, কখন কোন দিকে বাঁকিতে হইবে সবগুলি পাখি একসঙ্গে টের পায় কি