পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
জননী

কবিয়া? ধানকলের এক কোণায় ছােট একটি পুকুর। ইঞ্জিন ঘরের ওদিকে আরও একটা বড় পুকুর আছে। বয়লারের ছাই ফেলিয়া ছােট পুকুরটির একটি তীরকে ওরা ধীরে ধীরে পুকুরের মধ্যে ঠেলিয়া আনিয়াছে, পুকুরটা বুজাইয়া ফেলিবে বােধ হয়। ছাই ফেলিবার সময় বাতাসে রাশি রাশি ছাই সাদা মেঘের মত টিনের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া রেলের বাঁধ পার হইয়া কোথায় চলিয়া যায়। আজকাল এসব শ্যামা যেমন ভাবে, চাহিয়া দেখে, কতকাল তেমনি ভাবে সে তা দেখে নাই। বিকালে ছাদে গিয়া সে মণিকে ছাড়িয়া দেয়। মণি বকুলের সঙ্গে ছাদময় ছুটাছুটি করে। আলিসায় ভর দিয়া শ্যামা কাছে ও দূরে যেখানে যা কিছু দেখিবার আছে দেখিতে থাকে। বােধ করে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব, একটা অজানা ঔৎসুক্য। পর পর অনেকগুলি গাড়ি রেললাইন দিয়া দুদিকে ছুটিয়া যায়, তিনটা সিগনেলের পাখা বারবার ওঠে নামে। ধানকলের অঙ্গনে কুলি মেয়েরা ছড়ানো ধান জড়ো করিয়া নৈবিদ্যের মত অনেকগুলি স্তূপ করে তারপর হোগলার টুপি দিয়া ঢাকিয়া ফেলে। ছোট পুকুরটিতে ধানকলের বাবু জাল ফেলান, মাছ বেশি পড়ে না—এতটুকু পুকুরে মাছ কোথায়? জাল ফেলাই সার। শ্যামার হাসি পায়। তাহার মামাবাড়ির পুকুরে ও জাল ফেলিলে আর দেখিতে হইতে না, মাছের লেজের ঝাপটায় জাল খান খান হইয়া যাইত। পারিপাৰ্শ্বিক জগতের দশা ও ঘটনা শ্যামা এমনিভাবে খুঁটিয়া খুঁটিয়া উপভােগ করে। বাড়িঘর, ধানকল, রেললাইন, রাস্তার মানুষ এসব আর কবে তাহার এত ভাল লাগিয়াছিল? অথচ মনে মনে অকারণ উদ্বেগ, দেহে যেন একটা শিথিল ভয়বোধ, হাইতােলা আলস্য। বিধান আজকাল বিকালের দিকে শঙ্করের বাড়ি খেলিতে যায়, ছেলেকে না দেখিয়া তার কি ভাবনা হইয়াছে?

 শীতল বলে, বুড়ো বয়সে তোমার যে চেহারার খােলতাই হচ্ছে গো, বয়েস কমছে নাকি দিনকে দিন?

 শ্যামা বলে, দূর দূর! কি সব বলে ছেলের সামনে!

 শীতলের নজর পড়িয়াছে, শ্যামার ছেঁড়া কাপড় দেখিয়া তাহার চোখ টাটায়। শ্যামার জন্য সে রঙীন কাপড় কিনিয়া আনে। শ্যামা প্রথমে জিজ্ঞাসা করে, ক’টাকা নিলে? টাকা পেলে কোথা?