পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৪
জননী

পাহাড়ের সার চলে গিয়েছে গ্রামের ধার দিয়ে। পাহাড়ে উঠে দেখতে ইচ্ছা হল। গাঁ থেকে উড়িয়া মেয়েরা পাহাড়ের বনে কাঠ কাটতে যায়, তাদের সঙ্গে গেলাম। সে কি জঙ্গল রে শ্যামা, এইটুকু সরু পথ দুপাশে এক পা সরবার যাে নেই, যেন গাছপালার দেয়াল গাঁথা। ফিরবার সময় পথে হাতীর পাল পড়ল, আর নামবার যাে নেই। চারদিন হাতীর পাল পথ আটকে রইল, চারদিন আমরা নামতে পারলাম না। কি সাহস মেয়েগুলাের বলিহারি যাই, চারদিন টুঁ শব্দটি করলে না, রাত্রে আমাকে বলত ঘুমােতে আর নিজেরা কাঠকাটা দা বাগিয়ে ধরে পাহারা দিয়ে জেগে থাকত। আর একদিন—

 সেদিন আর মামার জিনিসপত্র আনা হইল না, পরদিন গিয়া লইয়া আসিল।

 শ্যামা ভাবিয়াছিল মামা কত জিনিস না জানি আনিবে, হয়ত আঁটিবেই না ঘরে! মামা কিন্তু আনিল ক্যাম্বিশের একটা ব্যাগ আর কম্বলে জড়ানো একটা বিছানা, লেপ তােষক নয়, দুটো ব্যাগ খানতিনেক সুতির চাদর আর এই এতটুকু একটা বালিশ।

 শ্যামা অবাক হইয়া বলিল, এই নাকি তােমার সব জিনিস মামা?

 মামা একগাল হাসিল, ভবঘুরের কি আর রাশ রাশ জিনিস থাকে মা? ব্যাগটা হাতে করি, বিছানা বগলে নিই, চলাে এবার কোথায় যাবে দিল্লী না বোম্বাই। ব্যাগটা হাতে তুলিয়া বিছানা বগলে করিয়া মামা যাওয়ার অভিনয় করিয়া দেখাইল।

 তাই হইবে বােধ হয়। আজ এখানে কাল সেখানে করিয়া যে বেড়ায়, বাক্স প্যাঁটরার হাঙ্গামা থাকিলে তাহার চলিবে কেন? কিন্তু এমন ভবঘুরেই যদি মামা হইয়া থাকে, তবে তাে টাকাকড়ি কিছুই সে করিতে পারে নাই? শ্যামা ভাবিতে ভাবিতে কাজ করে। প্রথমে সে যে ভাবিয়াছিল বিদেশে মামা অর্থোপার্জন করিয়াছে, বেড়াইয়া বেড়াইয়াছে শুধু, ছুটি-ছাটা সুযোগ-সুবিধা মত, হয়ত তা সত্য নয়। মামার হয়ত কিছুই নাই। দেশে দেশে সম্পদ কুড়াইয়া বেড়ানাের বদলে হয়ত শুধু বাউল সন্ন্যাসীর মত উদ্দেশ্যহীনভাবেই সে দুনিয়া বেড়াইয়াছে। কিন্তু এমন যে সাহসী, কত রাজা-রাজড়ার সঙ্গে যে খাতির জমাইয়াছে, পার্থিব সম্পদ লাভের সুযোগ কি সে কখনাে