পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৬৫

পায় নাই? পথে ঘাটে লোকে তো হীরাও কুড়াইয়া পায়! বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবা পশ্চিমে গিয়াছিলেন কপর্দকহীন অবস্থায়, কোথাকার রাজার সুনজরে পড়িয়া বিশ বছর দেওয়ানী করিলেন, দেশে ফিরিয়া দশ বছর ধরিয়া পেন্সনই পাইলেন বছরে দশ হাজার টাকার। মামার জীবনে ওরকম কিছুই কি ঘটে নাই? কোনো দেশের রাজার ছেলের প্রাণ-টান বাঁচাইয়া লাখ টাকা দামের পান্না মরকত একটা কিছু উপহার?

 মামা নিঃস্ব অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে শ্যামার ইহা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় না। একবার তাহাদের গ্রামে এক সন্ন্যাসী গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া ছিল, সন্ন্যাসীর সঙ্গে ছিল পুরু কাঠের ছোট্ট একটি জল চৌকী, তার ভিতরটা ছিল ফাঁপা, পুলিশ নাকি স্ক্রুর মত ঘুরাইয়া ছোট ছোট পায়া চারটি খুলিয়া তক্তার ভিতরে একগাদা নোট পাইয়াছিল। মামার ব্যাগের মধ্যে, কোমরের থলিতে হয়ত তেমনি কিছু আছে? নোট না হোক, দামী কোন পাথর টাথর?

 মামা স্থায়ী ভাবে রহিয়া গেল। ভারি আমুদে মিশুক লোক, কদিনের মধ্যে পাড়ার ছেলে বুড়োর সঙ্গে পর্যন্ত তাহার খাতির জমিয়া গেল, এবাড়িতে দাবার আড্ডায়, ও-বাড়িতে তাসের আড্ডায় মামার পশারের অন্ত রহিল না। মামার প্রতি এখন শীতলের ভক্তি অসীম, মামার মুখে দেশ বিদেশের কথা শুনিতে তাহার আগ্রহ যেন দিন দিন বাড়িয়া চলে, মামাকে সে চুপ করিতে দেয় না। মামা আসিবার পর হইতে সে কেমন অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছে, চোখে কেমন উদাস উদাস চাউনি। শ্যামা একটু ভয় পায়। ভাবে, এবার আবার মাথায় কি গোলমাল হয় দ্যাখো!

 ঠিক শীতলের জন্য যে শ্যামার ভাবনা হয় তা নয়, শীতলের সম্বন্ধে ভাবিবার তাহার সময় নাই। তার গুছানো সংসারে শীতল কবে কি বিপর্যয় আনে এই তার আশঙ্কা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক দাঁড়াইয়াছে তাহাদের। সংসার শ্যামার, ছেলেমেয়ে শ্যামার—ওর মধ্যে শীতলের স্থান নাই,—নিজের গৃহে নিজের সংসারের সঙ্গে শীতলের সম্পর্ক শ্যামার মধ্যস্থতায়, গৃহে শীতল শ্যামার আড়ালে পড়িয়া থাকে, স্বাধীনতাবিহীন স্বাতন্ত্র্যবিহীন জড় পদার্থের মত। একদিন শীতল মদ খাইত, শ্যামাকে মারিত,