পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭০
জননী

দোতালায় ঘর তোলা আরম্ভ করিল, বলিল, জানো মামা, উনি বলেন আমি নাকি কেপ্পনের একশেষ, নিজে তো ডাইনে-বাঁয়ে টাকা ছড়ান,—আমি মরে বেঁচে কটা রেখেছি বলে না ঘরখানা উঠছে? সংসারে ওনার মন নেই, উড়ু উড়ু কচ্ছেন। আমিও যদি তেমনি হই সব ভেসে যাবে না, ছারখার হয়ে যাবে না সব? টাকা রাখব আমি, ইঁট-সুরকি কিনব আমি, মিস্ত্রি ডাকব আমি তারপর ঘর হলে শোবেন কে? উনি তো? আমি তাই জন্তু জানোয়ার,—যন্তর! কথা কইনে সাধে? কইতে ঘেন্না হয়।

 মামা বলিল, সেকি মা, কথা বলিসনে কি?

 শ্যামা বলিল, বলি, দরকার মত বলি।—পঁয়ত্রিশ বচ্ছর বয়স হল আজে বাজে কথা আর মুখে আসে না, দোষ বল দোষ, গুণ বল গুণ, যা পারিনে তা পারিই নে।

 ঘর তুলিবার হিড়িকে শ্যামা, আমাদের ছেলে-পাগলা শ্যামা, ছেলেমেয়েদের যেন ভুলিয়া গিয়াছে। কত আর পারে মানুষ? সংসারে উদয়াস্ত খাটিয়া আগেই তাহার অবসর থাকিত না, এখন মিস্ত্রির কাজ দেখিতে হয়, এটা ওটা আনাইয়া দিতে হয়, ঘর তোলার হাঙ্গামা কি কম! শ্যামা পারেও বটে! এক হাতে ছোট ছেলেটাকে বুকের কাছে ধরিয়া রাখে, সে ঝুলিতে ঝুলিতে প্রাণপণে স্তন চোষে, শ্যামা সেই অবস্থাতে চরকির মত ঘুরিয়া বেড়ায়, ভাতের হাঁড়ি নামায়, তরকারি চড়ায়, ছাদে গিয়া মিস্ত্রির দেয়াল গাঁথা দেখিয়া আসে, ভাঙা কড়াইয়ে করিয়া চুন নেওয়ার সময় উঠানে এক খাবলা ফেলিয়া দেওয়ার জন্য কুলিকে বকে, শীতলকে আপিসের ও বিধানকে স্কুলের ভাত দেয়, মাসকাবারি কয়লা আসিলে আড়তদারের বিলে নাম সই করে, খরচের হিসাব লেখে, ছোট খোকার কাঁথা কাচে (রাণী এ কাজটা করে না, তার বয়স অল্প এবং সে একটু সৌখিন) আবার মামার সঙ্গে, প্রতিবেশী নকুড়বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্পও করে। চোখের দিকে তাকাও, বাৎসল্য নাই, স্নেহ মমতা নাই, শ্রান্তি নাই,—কিছুই নাই! শ্যামা সত্যই যন্ত্র নাকি?

 মামা বলে, খেটে খেটে মরবি নাকি শ্যামা? যা যা তুই যা, মিস্ত্রির কাজ আমি দেখব’খন।

 শ্যামা বলে, না মামা, তুমি বুড়ো মানষ, তোমার কেন এসব ঝঞ্ঝাট